সেভ্ন্ আপ দিল্লী এক্সপ্রেস—ডাকনাম যাহার তুফান মেল—তাহারই একখানা থার্ডক্লাস কামরায় আমাদের নাটকের আরম্ভ এবং সেইখানেই যবনিকা।
গাড়িতে সেদিন অসম্ভব ভিড় হইয়াছিল। সেই অবস্থার মধ্যেও শেষ মুহূর্তে একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক সকলকে ঠেলিয়া-ঠুলিয়া উঠিয়া পড়িলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে মোটঘাট বিশেষ ছিল না, একটি স্যুটকেস মাত্র হাতে করিয়া তিনি উঠিলেন।
ট্রেন ছাড়িবার অল্প কিছুক্ষণ পরেই সহসা তাঁহার নজরে পড়িল ওধারে একটি ভদ্রলোক জানালার ওপর হাত রাখিয়া কনুইটি বাহির করিয়া বসিয়া আছেন। তিনি যেন ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, ও মশাই! শুনছেন, ও দাদা—দয়া করে কনুইটা ভেতরে টেনে নিন, আমি হাত জোড় করছি!
কনুই-এর মালিক হাত ভিতরে টানিয়া লইলেন বটে কিন্তু অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া ভদ্রলোকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। উপস্থিত অন্য সকলেরও প্রায় সেই অবস্থা। তিনি অতঃপর ধীরে-সুস্থে আমাদের দিকে চাহিয়া কারণটা বিবৃত করিলেন, এখনও পাঁচটি দিন হয়নি মশাই, ওয়ালটেয়ার থেকে আসছিলুম মাদ্রাজ মেলে, এক ভদ্রলোক অমনি কনুই বার ক’রে বসে ছিলেন। দেখতে দেখতে মশাই—হাতখানি তিন টুকরো!
চারদিক হইতে একটা বিস্ময়ের গুঞ্জন উঠিল। যিনি কনুই বাহির করিয়া বসিয়া ছিলেন, তাঁহারও রীতিমত মুখ শুকাইয়া গেল।
ওধারের বেঞ্চ হইতে একটি মাড়োয়ারী যুবক বলিয়া উঠিল, লেকিন ক্যায়সে কাটা বাবুজী?
ভদ্রলোক একটু যেন উষ্ণভাবেই কহিলেন, পাথর! পাথর! পাহাড়কা উপরসে পাথর গিরা! ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করিলাম, বলেন কি মশাই!
যাবে না? সে কি যা তা পাথর? অন্তত আট-ন’ মন ওজন হবে!
একজন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ট্রেনে জার্নি করা প্রাণ হাতে ক’রে।
—যতক্ষণ না ফিরে আসছেন ততক্ষণ বিশ্বাস নেই।… এই ত মাস-খানেকের কথা, দানাপুর স্টেশনে গাড়ি থেমেছে, আমাদের হরেনবাবু স্টলে গেছেন চা খেতে; ফিরে আসতে আসতেই গাড়িটা দিয়েছে ছেড়ে। সামান্য স্পীড, কিন্তু ভদ্রলোক একটুখানি পা পিছলে যেমন গ’লে পড়ে গেলেন আর অমনি দু’টুকরো।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি তাঁহার যুবক সঙ্গিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, হাতরাস থেকে মথুরার ট্রেন ধরে কাজ নেই, বরং বাসে গেলেই হবে।
আমাদের নবাগত ভদ্রলোকটি আরও যেন তাতিয়া উঠিলেন, বাস? ও আরও ডেঞ্জারাস। আমার এক মাস্টারমশাই আসছিলেন তমলুক থেকে বাসে ক’রে। হঠাৎ মোড় ঘুরেই দেখা গেল, রাস্তার ওপর গোটাতিনেক ছাগল-ছানা। তাদের বাঁচাবার জন্য ড্রাইভার যেমন পাশ কাটাতে গেছে, একেবারে উঁচু রাস্তার ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে বাসসুদ্ধ চলে গেল নিচের জমিতে। সতেরো জন প্যাসেঞ্জারের মধ্যে তিনজন তখনই মারা গেল, আর দু’জন হাসপাতালে পৌঁছে গেল।
শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেরই এই বর্ণনায় গা-মাথা ঝিম্ ঝিম্ করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ প’রে প্রথম ভয়ের ব্যাপারটা কাটিতে আমাদের বিরাজবাবু সেই মথুরাযাত্রী বৃদ্ধাটিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ও বাসে-ফাসে কখনও চড়তে নেই মশাই, ভারি বিপজ্জনক! যদি নিজের মোটর থাকে, কিংবা ট্যাক্সি—
—তাতেই বা কি সুবিধে মশাই? সেদিন কাগজে পড়েন নি, বড়বাজারের এক মহাজনের কি দুর্গতি? নিজে মোটর চালিয়ে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে গেল আর ফিরল না। অনেক খুঁজে দেখা গেল যে, গড়ের হাটের কাছে এক বিরাট বটগাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মোটরখানা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে প’ড়ে রয়েছে, আর তার সঙ্গে মোটরের মালিকও। … নিজের মোটরের ত ঐ হাল, আর ট্যাক্সির ত কথাই নেই, রোজ অন্তত চারটে করে অ্যাকসিডেন্ট।
বিরাজবাবু নিজে অনেকখানি সরিয়া বসিয়া নবাগত ভদ্রলোককে বসিবার স্থান করিয়া দিলেন।
প্রায় সমস্ত গাড়ি জুড়িয়া শুরু হইল বিবিধ, বিচিত্র দুর্ঘটনার আলোচনা। নিজের জীবনে যিনি যত রকম দুর্ঘটনা দেখিয়াছেন, তাহাই মহা উৎসাহে বর্ণনা করিতে বসিলেন। যাঁহারা দেখেন নাই, তাঁহারা শোনা কথাকে অলঙ্কার দিয়া বর্ণনা করিতে বসিলেন এবং খবরের কাগজের আদ্যশ্রাদ্ধ হইতে লাগিল।
ইতিমধ্যে আমাদের নবাগত ভদ্রলোক তাঁহার তীক্ষ কণ্ঠস্বরে আর সকলের কথা ডুবাইয়া পুনশ্চ কহিলেন, কোন্ যানবাহনটা নিরাপদ? সাইকেল? শহরে সাইকেল চালানো ত প্রাণ হাতে ক’রে, এই বুঝি চাপা পড়লুম, সর্বদা এই ভয়। ঘোড়ার গাড়ির ত কথাই নেই, ঘোড়া ক্ষেপে উঠলেই চোখে অন্ধকার।
এক অর্বাচীন বালক বলিয়া ফেলিল, আগেকার হেঁটে যাওয়াই ছিল ভাল।
—ওরে বাবা! পদচারীদের ত স্থানই নেই। ট্রাম-বাস-মোটর-ঘোড়া এসব ত আছেই আর যেখানে গাড়ি-ঘোড়া নেই সেখানে সাপ-খোপ আছে।
সম্মুখের বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ফোঁস করিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, বাইরে বেরোলেই অপঘাত মৃত্যুর আশঙ্কা, তার চেয়ে ঘরে বসে থাকাই ভাল।
—কিছু না, কিছু না, দেখলেন ত বিহারের ভূমিকম্পের সময়? যারা বাইরে টাইরে ছিল তারা বরং এক রকম ক’রে বেঁচেছে, যারা ঘরের মধ্য ছিল, তাদের ত আর চিহ্ন রইল না।
মথুরাযাত্রী ভদ্রলোকটি আর সহ্য করিতে পারিলেন না, ভ্যাঁক্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া কহিলেন, মশাই, তা’হলে কি আর কোন উপায় নেই?
নবাগত ভদ্রলোকটি চিন্তিত মুখে কহিলেন, নাঃ—অ্যাকসিডেন্টের হাত এড়াবার কোন উপায় নেই। তবে যদি অল্প স্বল্প কিছু হয় কিংবা পরিবারদের কোনও ব্যবস্থা করতে চান তা’হলে উপায় আছে বটে।
চারিদিক হইতে ব্যাগ্র-ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন আসিতে লাগিল, কি রকম, কি রকম? কি বললেন মশাই? ইত্যাদি।
ভদ্রলোক কহিলেন, আজকাল সব বিলিতি ইনসিওরেন্স কোম্পানিই অ্যাকসিডেন্ট ইনিসওরন্সে করছে, সেগুলো মন্দ নয়। যদি হাত-পা ভাঙে কিংবা একেবারে মারা যান তা’হলে মোটা টাকা দেবে, আর যদি অসুখ-বিসুখ করে তা’হলেও মাসোহারা দেবে—ভারি চমৎকার পলিসি। আমার কাছেও আছে একটা প্রসপেকটাস, দেখবেন?
ভয়ের পরিবর্তে অনেকেরই মুখে-চোখে ক্রোধের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। একজন ত স্পষ্টই বলিয়া ফেলিল, ও; আপনি এজেন্ট বুঝি? তাইতে অত ভয় দেখাচ্ছিলেন?
ভদ্রলোক বিন্দুমাত্র বিচলিত হইলেন না। ধীরে-সুস্থে স্যুটকেস খুলিয়া কতকগুলি কাগজপত্র বাহির করিয়া কহিলেন, আজ্ঞে ভয় ত আর আমি মিথ্যে ক’রে দেখাইনি। কোন্ কথাটা ওর মধ্যে বাজে?… হাত পা ভেঙে যখন বাড়িতে এসে বসবেন, তখন যদি টাকাটা পান সেটা ভাল, না ভিক্ষে করা ভাল? নাকি আপনি টাকাটা পেলে আমায় দেবেন?
তারপর প্রশান্তভাবে মথুরাযাত্রী ভদ্রলোকের হাতে একখানা প্রসপেকটাস দিয়া কহিলেন, ভাল ক’রে প’ড়ে দেখুন।
যে ভদ্রলোক কনুই টানিয়া লইয়া ছিলেন, তিনি পুনরায় জানালায় হাত বাহির করিয়া বসিলেন। [সংক্ষেপিত]
গজেন্দ্রকুমার মিত্র: বিশ শতকের শেষ দিকে বাংলা সাহিত্যে রহস্য ও রোমাঞ্চ কথা সাহিত্যিক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ৩১, ২০১০
Leave a Reply