উপন্যাসের ভেতরটা যে একটা কার্নিভালের মতো, যেখানে হরেক রকমের কণ্ঠ, হরেক কিসিমের কথা শোনা যায়, যেগুলোর মধ্যে অনেক সময় ঠোকাঠুকিও লেগে যায়—এ রকম কথা আমাদের শুনিয়ে দিলেন মিখাইল বাখতিন মহাশয়। উপন্যাস-তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় বাখতিনকে এড়ানো মুশকিল। কিন্তু আমি তো আলোচনা করছি একটি উপন্যাস নিয়ে, তাহলে তাঁর উল্লেখ কেন? উল্লেখ এই কারণে, তাঁর কার্নিভাল-চিন্তার একটা চমত্কার প্রয়োগ যেন দেখা গেল সখী রঙ্গমালায়। কত উপন্যাসই তো পড়লাম গত কয়েক বছরে। তার কয়টার ভেতর দিয়ে এ রকম আনন্দিত ভ্রমণ করলাম? যদিও সখী রঙ্গমালায় আনন্দ মোটামুটি অনুপস্থিত; যেটুকু আছে তা এই রঙ্গি-রাজচন্দ্রের প্রণয় অভিসারে অথবা চান্দা বীরের মনুষ্য বধে। আমার পড়া কোনো কোনো উপন্যাসকে মনে হয়েছে যেন ধার করা ভাষা দিয়ে সাজানো; কোনো কোনো উপন্যাস যেন চিন্তিত পুরোহিতের নীতি ও ঔচিত্য দর্শন; কোনো কোনোটার ভাষা তো লাঠিতে ভর করে দাঁড়ানো। কার্নিভালের মতো উপন্যাসের ভাষায় যদি বৈচিত্র্য, স্ফূর্তি, কৌতুক আর ছুটে চলার আনন্দ না থাকে; তাহলে তা পড়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সখী রঙ্গমালার ভাষার তুলনা আমার খুব কমই চোখে পড়েছে। সাধু-চলিত, বাংলা-ফার্সি, নোয়াখালী, তদ্ভব-প্রাকৃত, মেজাজি-আয়েশি, কথ্য-পোশাকি—এ রকম নানা মাত্রায় ও বৈপরিত্যে এর ভাষার যে বিস্তার, তার আস্বাদ নেওয়াটাও আনন্দের ব্যাপার। সন্দেহ নেই যে এই ভাষাটাও নির্মিত, সাজানো; এ কারও ব্যবহারের ভাষা নয়। কিন্তু এই সাজানোতে যদি সপ্রাণ কুশলতা থাকে, গভীরতা আর নতুনত্ব থাকে, তাহলে এর প্রতি শুরু থেকেই একটি পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়ে যায়। শাহীন আখতার, এই ভাষার কারিগর, উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও ছন্দপতনের সুযোগ দেননি নিজেকে; যদিও এক পাতার কাক বা কবুতর হঠাত্ অন্য পাতায় কাউয়া বা কইতর হয়ে গেলেও কেন হয়, তার ব্যাখ্যার জায়গা রাখেননি: বর্ণনাকারী তো ওই একজনই, সর্বজ্ঞ যিনি।
সখী রঙ্গমালার কাহিনি নোয়াখালীর একটি পালাগান চৌধুরীর লড়াই থেকে নেওয়া। শাহীন আখতার জানাচ্ছেন, ‘চৌধুরীর লড়াই কবিকল্পিত শুদ্ধ পালাগান নয়, খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধের তত্কালীন ভুলুয়ার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।’ এই ঘটনার ডালপালা অনেক জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যেগুলো এক করে উপন্যাসটি লিখেছেন শাহীন আখতার। এই ‘এক করার’ ব্যাপারটা হলো গবেষণা। তাঁর গবেষণাটি নিখাদ। আড়াই শ বছরেরও বেশি আগের নোয়াখালীর মানুষের জীবনযাপন, পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ি, বিশ্বাস-আচার আর বিবাদ-বিসম্বাদের বিবরণগুলো যে কতটা বিশ্বস্ত, এ অঞ্চলের সমাজ ইতিহাসের কোনো বই পড়লে তা বোঝা যাবে। উপন্যাসটি লেখার পেছনে যে নিষ্ঠার প্রমাণ মেলে, উপন্যাসেও তার দেখা পাওয়া যায়। এত অসংখ্য মানুষ, উপন্যাসটিতে এত ভূপ্রকৃতি বর্ণনা, এত ঘটনার বিস্তার, কিন্তু কোথাও পূর্বাপরতায় কোনো ছেদ নেই, আগে-পিছের অমিল নেই। আমি নিজে সাত পৃষ্ঠার বেশি কোনো কাহিনি লিখতে বসলে চরিত্রের নাম, সকাল-বিকেল, শীত-বসন্ত এসব নিয়ে গোলমালে পড়ি। শাহীন আখতার যেন দিনপঞ্জি লিখছেন—এক দিনের সঙ্গে আরেক দিনকে, এক চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রকে গুলিয়ে ফেলাটা তাতে সম্ভব নয়। এক নিপাট পূর্বাপরতায় উপন্যাসটি এগোয় বলে এর বৃত্তাকার আবর্তনটিও পাঠকের ‘শেষের স্বাদ’ পেতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। উপন্যাসটির শুরু চান্দা বীরের রঙ্গমালা-বধ ও তার কাটা মুণ্ডু হাতে রাজবাড়িতে ঢোকা দিয়ে, শেষ তার নিজের মৃত্যু ও রাজচন্দ্রের জমিদার হওয়া দিয়ে। রঙ্গির পরিণতি জেনেও তার প্রতিটি মুহূর্তে আমরা হাজির থাকি, আর অনুমান করতে পারি, চান্দা বীরেরও শেষটা সুখকর হবে না। একটি জানা ও একটি অজানা পরিণতি যখন সমান মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে, তখন বুঝতে হয় বর্ণনাকারী প্রকৃতই কুশলী।
সখী রঙ্গমালা গল্পটা অপরিচিত নয়, এটি একটি আর্কিটাইপের মতো পুরোনো। এক পিতৃহীন জমিদারকে ঠকাচ্ছে কাকা, ভোগদখল করছে তার সম্পত্তি। সেই ছেলেটিও জোয়ান হয়ে উচ্ছৃঙ্খল হলো, পড়ল এক নীচু জাতের সুন্দরী মেয়ের প্রেমে। উদ্বিগ্ন মা তার বিয়ের আয়োজন করল এক ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে। জমিদার তনয় যে রঙ্গিনীর সঙ্গ ছাড়বে না; তার স্ত্রীর কপাল যে সদরঘাট—এসব সহজেই অনুমেয়। আর যা যা ঘটে, সেসবও। ফলে সখী রঙ্গমালার ভেতরটা একটা রূপকথার গল্পের মতো কাঠামোবদ্ধ। অন্য কোনো বর্ণনায় এই কাঠামোটি গল্পের প্রাণ খেয়ে নিত। শাহীন আখতারের বর্ণনায় গল্পে যে প্রাণ সঞ্চারিত তা বরং খেয়ে ফেলে কাঠামোর লোহা-কাঠ। যদিও আমার মনে হয়েছে কাহিনিট শেষ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত না নিয়ে গেলেও চলত। রাজচন্দ্রের জমিদার হয়ে নতুন বিবাহ ও পুত্রসন্তান উত্পাদন, চৌধুরীদের নিয়ে লেখা পালা শুনতে তার প্রথম স্ত্রী ফুলেশ্বরীর পাগল হয়ে বেরিয়ে পড়াটা একটি ‘বিশেষ দ্রষ্টব্যে’র মতো মনে হয়েছে। জীবনমৃত ফুলেশ্বরীকে উপন্যাসের আর প্রয়োজন ছিল না। তবে চৌধুরীর লড়াই পালাগানে এ রকম উপসংহার থাকলে ভিন্ন কথা।
সখী রঙ্গমালার চরিত্রগুলো কত মাপের, কত জাতের, অবস্থানের; কিন্তু প্রত্যেকটি চরিত্রই জীবন্ত। গল্পটিতে যদিও বিয়োগের অভিঘাতই বেশি, তা জমাট বাঁধে না এর অন্তর্গত এক সূক্ষ্ম কৌতুকময়তার জন্য। এই কৌতুকময়তার উত্স জীবনের প্রতি বর্ণনাকারীর প্রসন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আখ্যান রচনার পরিমিতি বোধ, সব মিলিয়ে তৈরি হয় সখী রঙ্গমালার আকর্ষণ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply