১৯৬৯-এ লেখালেখি শুরু করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর দুবছর পর ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। দীর্ঘকাল পর ২০০৩-এ তিনি লিখলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দীর্ঘাবয়ব উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প। সম্প্রতি তাঁকে প্রলুব্ধ করেছে ১৯৬৯-এর স্বাধিকার আন্দোলন, যার ফলশ্রুতি মাতাল হাওয়া। মাতাল হাওয়া ২০১০-এর বাংলা একাডেমী বইমেলার জনপ্রিয়তম গ্রন্থ বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু যাকে বলে ঐতিহাসিক উপন্যাস, তা হুমায়ূন আহমেদের ধাতে নেই। তাঁর অভিলক্ষ্য মানব চরিত্র, রাজনীতি নয়। মানব চরিত্র যতটুকু সময়লগ্ন ঠিকই ততটুকুই, ইতিহাসলগ্ন তাঁর কাহিনী। কার্যত মাতাল হাওয়া ষাটের দশকের মফস্বলবাসী মানুষের গল্প। এ গল্পে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের কথা আছে, মওলানা ভাসনীর কথা আছে, শহীদ আসাদের কথা আছে, কিন্তু তাই বলে এখানে ইতিহাসের অনুসন্ধান হবে নিছকই পণ্ডশ্রম। মানুষের গল্পে মানুষ থাকে: হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো অসংখ্য মানুষের বিচিত্র প্রতিচ্ছবি। মাতাল হাওয়া যোগ করেছে আরও কিছু মানুষের রসসিঞ্চিত প্রতিবিম্ব; আরও কিছু মানবচরিত্র এ গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে বিচিত্র, মনোজ্ঞ ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে।
বিধবা হাজেরা বিবির কথা দিয়ে মাতাল হাওয়া শুরু। তাঁর পুত্র ময়মনসিংহ শহরের দুঁদে উকিল হাবীব। অন্যান্য গ্রন্থের মতোই মাতাল হাওয়ার কাহিনির সংক্ষেপ দাঁড় করানো মুশকিল। কারণ একটিই, আর তা হলো এটির সংজ্ঞায়িত কোনো প্লট নেই। হাসান রাজা চৌধুরী ছোটবেলায় দূরসম্পর্কের এক মামা আশরাফ আলী খানের বাড়িতে থেকে মোহনগঞ্জ পাইলট স্কুলে লেখাপড়া করত। মামা তাকে শারীরিকভাবে ব্যবহার করতেন। দশ বছর বয়সের বালক প্রতিবাদ করতে পারেনি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিল একদিন মামাকে খুন করবে সে। ইউনিভার্সিটির লেখাপড়া শেষ করার পর বাড়িতে ফিরে একদিন ভোরবেলায় বাবার দোনলা বন্দুক চালিয়ে দেয়, মামা মারা যান। ছেলেকে বাঁচাতে বাবা রহমত রাজা চৌধুরী হাবীব উকিলের শরণাপন্ন হন। সময়টা ১৯৬৮, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন মাতাল হাওয়া প্রবহমান। পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হাসান রাজা চৌধুরীকে নিজের বাসায় লুকিয়ে রাখলেন হাবীব।
হাবীবের মেয়ে নাদিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ফিজিক্সের শিক্ষক বিদ্যুত কান্তি দে তার প্রিয় শিক্ষক। ছুটিতে বাড়ি এলে তার পরিচয় হলো হাসান রাজা চৌধুরীর সঙ্গে। হাবীব উকিল সুকৌশলে মামলা সাজিয়েছেন। খুনের দায়িত্ব স্বীকার করবে তার পোষা মানুষ ফরিদ। ফরিদকে পরিচয় করানো হবে বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে; বন্দুক পরিষ্কার করার সময় যার হাত থেকে অসাবধানে গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল। মামলায় ফরিদের ফাঁসির আদেশ হলো। হাবীব তার মেয়ে নাদিয়ার সঙ্গে হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে ঠিক করলেন। হাসান রাজা চৌধুরী রূপবান ও সত্। বিয়েতে গভর্নর মোনায়েম খানের উপস্থিত থাকার কথা। এক ফাঁকে হাসান রাজা চৌধুরী ডিস্ট্রিক্ট জজের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে দিল। বিচার শুরু হলো নতুন করে। বিচারে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। এ সময় একদিন নাদিয়ার দাদিজান হাজেরা বিবির মৃত্যু হলো। চেম্বারে গিয়ে বাবাকে খবরটা দিয়ে বাগানে কদমগাছের নিচে একা বসে থাকে নাদিয়া। নির্জনে একাকী পেয়ে বাড়ির নতুন পাহারাদার ভাদু এগিয়ে আসে, অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নাদিয়ার ওপর। দিঘির পানিতে তার ভাসমান লাশ পাওয়া যায়; তার চোখ খোলা, যেন সে অবাক হয়ে পৃথিবী দেখছে।
যে কারও সঙ্গে একমত হতে আপত্তি নেই যে ওপরে যে কাহিনি বিধৃত তাতে বিশেষ কোনো কাহিনিচক্র নেই, যাকে বলা হয় নকশা বা ‘প্লট’। অন্যদিকে যিনি এ উপন্যাস পাঠ করেছেন, তিনি জেনেছেন কাহিনির ছায়ায় কোনো দর্শন বা তত্ত্বকথা কিংবা মহত্ কোনো বাণী প্রচারের চেষ্টাও লেখক করেননি। তবু শেষ পর্যন্ত গল্পের এক জাদুকরি প্রভাব আদ্যোপান্ত পাঠককে আবিষ্ট করে। গ্রন্থটির পাঠ শেষ হয় সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে। কী এই সন্তুষ্টির চাবিকাঠি তা ভেবে দেখার বিষয় বটে।
হাবীব এই কাহিনির প্রধান চরিত্র। হাবীব এই অর্থে প্রধান চরিত্র যে তাঁর উপস্থিতি কাহিনির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে এটি হাবীবের কাহিনি এ রকম ধারণা পাঠকের হবে না: কখনো এটি নাদিয়ার কাহিনি, কখনো তার দাদিজান হাজেরা বিবির। কখনো এটি ফরিদের কাহিনি, কখনো হাসান রাজা চৌধুরীর। এটি শেষ পর্যন্ত একক কারও কাহিনি নয়। এটি মানুষের কাহিনি—বিভিন্ন চরিত্রের মানুষ যারা সময়ের দাবিতে পরস্পর সংলগ্ন হয়ে থাকে। পরিবেশের চাপে হয়তো কখনো ব্যবহার বদলে যায়, কিন্তু মূল চারিত্রিক প্রবণতার পরিবর্তন হয় না। মুহুরি প্রণবের মতো মানুষ, সফুরার মতো মানুষ, নারায়ণ চক্রবর্তীর মতো মানুষ, বিদ্যুত কান্তি দের মতো শিক্ষক, শম্ভুগঞ্জের পীর সাহেবের মতো মানুষ, মোনায়েম খানের মতো মানুষ—এ রূপ অসংখ্য মানুষের সমাহারে পৃথিবী ঋদ্ধ। চিন্তা-চেতনা, ব্যবহার ও আচার-আচরণে এরা আলাদা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এদের প্রত্যেকেই গল্পের আঁকড়। লেখকের দায়িত্ব এই গল্পগুলো উদ্ধার করা; কিন্তু সব লেখক তা পারেন না। লেখকের পক্ষে সম্ভব বিচিত্র এই গল্পগুলোকে একটি যুক্তিসিদ্ধ পরম্পরায় সংগ্রন্থিত করে পরিবেশন করা; আবার বলতে হয়, সব লেখকের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। এই দুই সীমাবদ্ধতা লেখকের কলমকে স্তিমিত করে দেয়, যার ফলে উপন্যাস গল্পের শক্তিতে সপ্রাণ হয়ে উঠতে পারে না। আমাদের কথাসাহিত্যের অনতিক্রমণীয় দীনতার পেছনের অন্যতম কারণ গল্পের ঘাটতি।
লক্ষ করলে দেখা যায়, একটি নকশা বা প্লটের মধ্য দিয়ে কোনো একটি সমস্যা রেখায়িত করতে বা বিশেষ কোনো বাণী চিত্রিত করতেই প্রায় সব লেখক অভ্যস্ত। বহু গল্প-উপন্যাসের প্রচ্ছদ নামের মধ্যেই লেখকের উদ্দেশ্য স্পষ্টাকারে বর্ণিত থাকে। এই অভ্যস্ততা লেখককে দিকভ্রষ্ট করে, কেননা উদ্দেশ্যসংবলিত উপন্যাস রচনার অন্তর্নিহিত প্রেরণার কাছে অভিজ্ঞতাধৃত গল্পগুলো উপেক্ষিত হয়। অন্যদিকে দেখা যায়, হুমায়ূন আহমেদ লিখে থাকেন প্রধানত গল্প শোনানোর লক্ষ্য নিয়ে। মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে, মানুষকে তিনি গল্প শুনিয়েছেন। পাঠক তা তৃপ্তি ভরে গ্রহণ করেছে। সাহিত্যের কাছে মানুষের মৌলিক দাবি গল্পের। এই দাবি উপেক্ষা করে কথাসাহিত্য রচনার প্রচেষ্টা মহত্ হতে পারে বটে কিন্তু পাঠকের হূদয় স্পর্শ করা যায় না। হুমায়ূন আহমেদ আবিষ্কার করেছেন গল্পের শক্তিতেই কাহিনি জাদুকরি হয়ে ওঠে। তিনি উপন্যাস লিখতে বসেননি, ছোট গল্পও না; কেবল মানুষের গল্প গেঁথেছেন নিপুণ দক্ষতায়।
যেকোনো কারণেই হোক, ঐতিহাসিক সত্য এই যে গদ্যলেখকের জন্য বিকল্প দুটি মাধ্যম তৈরি হয়ে গেছে, যার একটি ছোটগল্প, দ্বিতীয়টি উপন্যাস। গদ্যের এই দুটি রূপ গত দু-তিন শ বছরে সম্ভাব্য আর সকল কাঠামোর সুযোগ নস্যাত্ করে একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করেছে। আমাদের লক্ষ করা প্রয়োজন যে হুমায়ূন আহমেদ এই দুটি কাঠামোর পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ‘গ্রন্থ’ ছোটগল্পও নয়, প্রচলিত অর্থের উপন্যাসও নয়। এ কারণে তাঁর সাহিত্যিক মূল্যায়ন একটি দুরূহ প্রস্তাবনা। তিনি গল্প পরিবেশন করেছেন, তজ্জন্য কখনো ক্ষুদ্র পরিসর যথেষ্ট হয়েছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়েছে ব্যাপ্ত পরিসরের। ছোটগল্প ও উপন্যাসের প্রচলিত ছকের বাইরে যে কেবল গল্পেরই অপার শক্তি আছে হুমায়ূন আহমেদ তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন সংশয়াতীতভাবে। তাঁর লেখনীর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার যে রহস্য তার একটি সম্ভবত বিচিত্র গল্পের উপর্যুপরি ও নিবিড় ‘মোজাইক’। এই অনুধাবন যেকোনো কথাসাহিত্যিকের সাফল্যের জন্য একটি জরুরি শর্ত বললে অত্যুক্তি হবে না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
tania
somalochona valo laglo.