কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন গল্প-উপন্যাসের বিষয় চয়নে বরাবর বৈচিত্র্যের সন্ধানী। ‘নূতনের পিয়াসী’। উপকূলীয় মানুষকে নিয়ে তিনি যেমন উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি কাহিনি সাজিয়েছেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ নিয়েও। তাঁর উপন্যাসে অনায়াসে গণসংগ্রামের ঐতিহাসিক কুশীলবেরা স্থান পান, আবার সহজে জায়গা করে নেন পৌরাণিক লোকশিল্পীরাও।
বিভিন্ন জনপদের মানুষের কথা আমাদের গল্প-উপন্যাসে উঠে এলেও এত দিন প্রায় অনালোচিত থেকেছে ছিটমহলের বাসিন্দাদের জীবন। সেলিনা হোসেন তাঁর ভূমি ও কুসুম উপন্যাসে তাদের জীবনগাঁথা তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। বাংলাদেশের একেবারে উত্তর প্রান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডবেষ্টিত ছিটমহল দহগ্রাম আঙ্গরপোতা (যদিও উপন্যাসে আঙ্গরপোতার উল্লেখ নেই)। দেশ বিভাগের খড়্গ এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে স্থায়ী বিভাজন তৈরি করে। মুসলমানেরা পাকিস্তান নামে পৃথক ভূখণ্ড পেলেও দহগ্রামের মানুষ স্বাধীন হয় না; তাদের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী। তারা মূল ভূখণ্ডে যেতে পারে না, নিয়ত বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। এ সবই ভূমি ও কুসুম উপন্যাসের পটভূমি।
উপন্যাসের এক জায়গায় আমরা লক্ষ করি, রাস্তার অপর পারে পাটগ্রাম, লালমনিরহাট জেলার একটি উপজেলা। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হুকুম ছাড়া কেউ পাটগ্রামে যেতে পারবে না। তিনবিঘার পাশে রাস্তা বন্ধ করে ওদের খবরদারি চালু হতে যাচ্ছে।…সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মারা যায় সুরেন ঢালি। তার আগে আহত সুরেনকে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যাওয়ারও অনুমতি মেলে না। মালতী প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরাই আমাদের সীমান্তরক্ষী। আমাদের বন্দুক নেই তো কী হয়েছে, সাহস আছে।’
শত ঝড়ঝঞ্ঝা, শোক, ব্যাধি, মৃত্যুতেও সেখানে জীবন থেমে থাকে না। লেখকের ভাষায়, ‘একসময় ছিটের ভূমিতে ঘাস গজায়। সবুজ ঘাসের মাথায় সাদা কুসুম ফোটে। যতগুলো ঘর পুড়েছিল তার সবগুলো ওঠানো হয়। পুড়ে যাওয়া মানুষেরা মুক্ত হয়। খেতে ধান পাকে। কাটার সময় হয়। পাকা ধানের আঁটিতে উঠোন ভরে থাকে।’
গ্রামের বাসিন্দা মনজিলা ভালোবাসতেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী অরবিন্দকে; তাঁদের ভালোবাসার ফসল তানজিলা। এ অসম ভালোবাসার দায় সারা জীবন বয়ে বেড়ান মনজিলা। সম্ভবত তিনিই এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র; শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখক তাঁকে প্রতীকায়িত করেছেন একজন সাহসী ও সংগ্রামী নারী হিসেবে। একটি দারিদ্র্যপীড়িত ও সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বাস করেও তিনি সামাজিক প্রথাগুলো ভেঙেছেন, সন্তানের পিতার পরিচয় নিয়ে কোনো অনুশোচনা করেননি। বাবা-মা তাঁকে পরিত্যক্ত করলে নমিতা বাগদি নামে এক বৃদ্ধার ডেরায় আশ্রয় নেন মনজিলা।
গোলাম আলি উপন্যাসের আরেকটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। তিনি নিজে সংসারবিবাগী, কিন্তু মিশে যান সবার সংসারে, তাদের বিপদ-আপদে সাহায্য করেন। তাঁর উদ্যোগেই দহগ্রামে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ বিভাগের পর তাঁর কণ্ঠে আক্ষেপ শুনতে পাই, ‘আমাদের বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল।’ তবে হাল ছাড়েন না গোলাম আলি। তিনি জানেন, ‘ছোট এই ভূখণ্ডে সবাই যদি সবার কাছে না থাকে তাহলে তো বেঁচে থাকা কঠিন হবে।’ এ উপলব্ধি থেকেই দহগ্রামে তাঁর জীবন সংগ্রাম শুরু হয় এবং তাতে যুক্ত হয় কাজেম মিয়া, খাদিজা বানু, মালতী, নিতাই, রুমালি, নূরুল, বাশার, আকালি, তাহের, সরমা নেহাল কার্তিক। আরও অনেকে।
উপন্যাসের পটভূমি বিশাল। চরিত্র অনেক। যাদের কাছে রাষ্ট্রের, জীবন উপভোগের চেয়ে বেঁচে থাকা বড়। ছিটমহলের বাসিন্দারা কখনো স্বাধীনতার স্বাদ পায় না, পরাধীনতা বারবার তাদের স্বপ্ন-সাধ ভেঙে-চুরে দেয়। তবুও জীবন প্রবহমান। উপন্যাসে সেলিনা হোসেন ছিটমহলের পীড়িত-তাড়িত মানুষের জীবনসংগ্রাম তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন, ক্ষুধা যাদের নিত্যসঙ্গী, সীমান্তরক্ষীর বন্দুক যাদের প্রতিনিয়ত ধাওয়া করে।
লেখকের কুশলী উপস্থাপনায় গোলাম আলি, নমিতা বাগদি, মনজিলা ও তানজিলার চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনজিলার অসমাপ্ত কাজটি স্বেচ্ছায় তুলে নেন তাঁর কন্যা তানজিলা, গোলাম আলি আদর করে যাঁর নাম রেখেছিলেন বর্ণমালা। এ যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে জ্বালিয়ে রাখা দীপশিখা।
সাতচল্লিশে উপন্যাসের যাত্রা শুরু, তারপর পাক-ভারত যুদ্ধ, তারপর ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয় ছিটমহলের বাসিন্দারা। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও দহগ্রামবাসীর যুদ্ধ শেষ হয় না।
ছিটমহল থেকেও অনেকে যুদ্ধে যায়। হোসেন আলি, তোয়াব ফিরে আসেন। তানজিলার স্বামী আজমল আসেন না। তাঁর রক্তমাখা জামাকাপড় নিয়ে আসে সাধু নামের এক তরুণ। তারপর শহীদ স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন তানজিলা। কিন্তু যেতে পারেন না। সীমান্তরক্ষীরা বাধা দেয়।
দুবারের স্বাধীনতাও ছিটমহলের বাসিন্দাদের জীবন বদল করেনি, তাদের দুঃখ ঘোচায়নি। শহীদ স্বামীকে উত্সর্গ করা ফুলগুলো সীমান্তেই সাজিয়ে রাখেন তানজিলা। প্রত্যয়ী উচ্চারণ তাঁর, ‘আমি ছিটের স্বাধীনতা চাই। আমাদের বন্দী করে রাখতে পারবা না; স্তব্ধ হয়ে থাকে চারদিক।’
এখানেই উপন্যাস শেষ।
সেলিনা হোসেনের এ উপন্যাসে নাটকীয়তা আছে। ছোট ছোট দুঃখ-বেদনা আছে, আছে প্রেম-ভালোবাসাও। তার চেয়েও বড় হয়ে আছে একসঙ্গে বাঁচার লড়াই। সে লড়াইয়ে কখনো তাঁরা জয়ী হন, কখনো পরাজিত। কিন্তু তাঁদের জীবন থেমে থাকে না। এ উপন্যাসে ইতিহাসের উপাদান আছে, সেলিনা হোসেন ইতিহাস লেখেননি। ইতিহাস ও কল্পনার মিশেলে একটার পর একটা ঘটনা সাজিয়েছেন। যে রাষ্ট্র মানুষের গড়া, সেই রাষ্ট্র তাদের জীবনকে কীভাবে তছনছ করে দেয় ছিটমহলের বাসিন্দা না হলে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায় না। রাষ্ট্রনেতারা কত সিদ্ধান্ত নেন, চুক্তি করেন, সীমানা অদল-বদল করেন, কিন্তু ছিটমহলের প্রান্তিক মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন নেই।
ভূমির সঙ্গে মানুষের যে নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক, যাকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করা যায় না, ঘটনা পরম্পরায় সেলিনা হোসেন তা-ই তুলে ধরেছেন ভূমি ও কুসুমে।
এ জন্য বাড়তি ধন্যবাদ তিনি পেতেই পারেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply