শনিবার এসএসসির রেজাল্ট পাওয়ার পর খুশিতে কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। আব্বাকে বাংলা সিনেমার নায়কের মতো এসে বললাম, ‘আব্বা, আব্বা, আমি এ প্লাস পেয়েছি।’
: কী পেয়েছ?
: এ প্লাস। এ প্লাস পেয়েছি।
আব্বা পকেট থেকে ১০ টাকার দুটি নোট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আব্বা কৃপণ তা জানি। তাই বলে এ প্লাস পাওয়ার পুরস্কার মাত্র ২০ টাকা? আমি বললাম, ‘মাত্র ২০ টাকা? এই টাকা দিয়ে কী হবে?’
: আরেকবার স্কুলে গিয়ে ভালোমতো তোর রোলটা দেখে আয়। তোর মতো ছাত্র এ প্লাস পায় কী করে? নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। ২০ টাকা হলো স্কুলে যাওয়া-আসার ভাড়া। যা।
আশ্চর্য! আব্বা কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? তা তো করার কথা না। তিনি রসিকতা একেবারেই পছন্দ করেন না। টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি দেখে গম্ভীর মুখে বলেন, ‘এটা কোনো দিন সম্ভব? ইঁদুর কীভাবে একটা বেড়ালকে লাথি মারে? কী সব দেখায়!’ আমি আব্বার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট চাচার ঘর পার হতেই তিনি ডাকলেন, ‘এই আবির, তোর রেজাল্টের কী খবর?’
: চাচা, আমি এ প্লাস পেয়েছি।
: কী বললি? এ প্লাস পেয়েছিস? এই কথাটাই ইংরেজিতে বল তো।
: ইংরেজিতে বলতে পারব না।
: এই সামান্য কথাটা ইংরেজিতে বলতে পারবি না? তুই এ প্লাস পেলি কীভাবে? নাহ, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আমার আস্থা এমনিতেই কম ছিল, তোর এই অবস্থা দেখে সেটা আরও কমে গেছে। আমি তো জাতির কোনো ভবিষ্যৎই দেখছি না। নো ফিউচার। আচ্ছা, ফিউচার বানান পারিস?
আমি কিছু না বলে চলে এলাম। একটা বাসায় সাধারণত একটা অদ্ভুত মানুষ থাকে। অথচ আমাদের বাসার প্রতিটা মানুষই অদ্ভুত। তা না হলে এ রকম কথা কেউ বলে?
রেজাল্ট দিয়েছে শনিবার। আজ সোমবার। অথচ আমি যে এ প্লাস পেয়েছি, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথাই নেই। বাসার সবার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এ প্লাস পাওয়া কোনো ঘটনাই না। সবাই পায়। ছেলে এ প্লাস পেয়েছে, কোথায় আরও বাসায় বাসায় মিষ্টি বিতরণ করে বলবে, ‘আপা, আমার ছেলেটা এ প্লাস পেয়েছে, দোয়া করবেন’ তা না, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সামনের বাড়ির বাড়িওয়ালার মেয়ে জিপিএ ৪.০০ পেয়েই প্রায় এক কেজি মিষ্টি দিয়ে গেছে, আর আমি জিপিএ ৫ মানে এ প্লাস পেয়েও ঝিম মেরে বসে আছি। মানসম্মানের ব্যাপার। বাইরে বের হলেই বন্ধুরা খোঁচা দিয়ে বলে, ‘দোস্ত, এ প্লাস পাইলা, মিষ্টি তো খাওয়াইলা না।’ আমি কিছু বলি না। আজকেও আম্মাকে বললাম, ‘আম্মা, বন্ধুরা মিষ্টি খেতে চাইছে।’
: মিষ্টি খাওয়ার কী আছে? পুষ্টিকর কিছু খাওয়া। তোদের এখন বাড়ন্ত শরীর। ভালো খাবার না খেলে হবে? তা ছাড়া এখনকার মিষ্টিতে কী না কী দেয়, ওসব খেলে অনেক সমস্যা হতে পারে। ওদের একদিন বাসায় আসতে বল, আমি সবজি দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে দিই।’
হায় খোদা! শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যসচেতন মা হিসেবে আম্মার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত। বন্ধুদের সবজি খিচুড়ির কথা বললে ওরা কী ভাববে কে জানে। নাহ, কিছু একটা করতে হবে। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারে বন্ধুরা কেউ কিছু বলার আগেই আমি ওদের সব বুঝিয়ে বললাম। আমার কথায় সবাই বেশ গম্ভীর হয়ে চিন্তা করতে লাগল কী করা যায়। হঠাৎ সৌরভের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যাটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
: শালা, হাসছ, না? এমন চড় দেব যে মুখের ঢাকনা বদলে যাবে।
: আরে, রাগ করছিস কেন? শোন, পাঙ্খাটাস্টিক বুদ্ধি পাইসি।
: পাঙ্খাটাস্টিক মানে কী?
: আরে, পাঙ্খা মানে ফ্যান, মানে ফ্যানটাস্টিক। সবাই শোন।
আমরা সবাই শুনলাম এবং বুঝলাম সৌরভের মাথায় গোবর আছে বলে আমাদের মধ্যে যে ধারণাটা ছিল, তা ঠিক নয়। ওর মাথায় অল্পবিস্তর বুদ্ধিও আছে। যেনতেন বুদ্ধি না, দারুণ বুদ্ধি। প্ল্যান অনুযায়ী সৌরভ কাজটা শুরু করল, আমি বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। বাসায় ঢুকতেই আম্মা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘আবির, তোর বাবা-চাচা কেউই তো বাসায় নেই। তুই এই টাকাগুলো দিয়ে মিষ্টি কিনে আন। এ প্লাস পেয়েছিস, সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে না?’
: মিষ্টি খাওয়ানোর কী আছে? পুষ্টিকর কিছু খাওয়ানো উচিত। সবজি দিয়ে খিচুড়ি রাঁধলে হয় না?
ফাজলামো করছিস? যা বলছি তাই কর। আর শোন, আসার সময় ১০ কেজি মিষ্টি ছাত্রলীগের অফিসে দিয়ে আসবি। আর ওদের সঙ্গে সালাম দিয়ে কথা বলবি। ছেলেগুলো খুবই ভালো। দেশের জন্য একেবারে জান দিয়ে দিচ্ছে। আহারে!
আমি বন্ধুদের নিয়ে মিষ্টি কিনতে বের হলাম। একটু হাঁটি আর সবাই একসঙ্গে হেসে উঠি। সৌরভকে বললাম, ‘দোস্ত, আম্মাকে ফোনে যা বলেছিস, তা আরেকবার বল না।’
সৌরভ গম্ভীর কণ্ঠে বলা শুরু করল, ‘স্লামালেকুম আন্টি, আমি এই এলাকারই ছেলে। আপনার ছেলে এ প্লাস পাইল, আমাদের তো একটু মিষ্টিমুখ করানো উচিত ছিল, তাই না? আমরাও তো ওর জন্য দোয়া করছি। আমাকে চিনতে পারছেন না? চিনবেন না, আমি বরকত। ছাত্রলীগের একজন সাধারণ কর্মী। আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি দিয়েন। নাইলে তো আমাদেরই দৃষ্টি দিতে হবে। একটা দায়িত্ব আছে না? আচ্ছা আন্টি, রাখি। স্লামালেকুম।’
আমরা আবার একসঙ্গে হেসে উঠলাম। সবাই মিলে মিষ্টি খাব ভাবতেই মজা লাগছে। এই প্রথম মনে হলো ছাত্রলীগ আসলে অনেক উপকারী।
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৭, ২০১০
Leave a Reply