দাদু বললেন, ‘আমাদের যুগে ইলেকট্রিসিটি যেত কি না, আমার খুব একটা মনে পড়ে না।’
আমি বলি, ‘তার মানে তোমার স্মৃতিশক্তি কমে গেছে। তুমি মনে করতে পারছ না।’
সুমন এসে বলে, ‘তুমি দেখি রূপকথার গল্প বলছ। যেমন গোয়াল ভরা মাছ, পুকুর ভরা…।’
দাদু হেসে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি। আর ভাবতে হবে না।’
দাদু কথা বলতে বলতেই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। পুরো পাড়ার লোকজনও আমাদের মতো আনন্দে জেগে উঠল।
মা এসে বললেন, ‘অ্যাই, তাড়াতাড়ি ক্লাসের পড়া শেষ করো। আবার কিন্তু কারেন্ট চলে যাবে।’
মা কথাটা বলেই রান্নাঘরে চলে গেলেন। সুমন দাদুকে বলে, ‘সত্যি তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন কারেন্ট যেত না?’
দাদু বলল, ‘যেত। তবে দু-এক মিনিটের জন্য। যেতে যেতেই আবার এসে পড়ত।’
সুমন বলে, ‘তাহলে এখন এমন হয় কেন?’
দাদু বিজ্ঞের মতো বলে, ‘ডারউইনের বিবর্তনবাদের কথা জানিস তো।’ আমি হাত তুলে বললাম, ‘জানি, জানি।’
দাদু বলেন, ‘কারেন্টের যাওয়া ও আসার বিবর্তনবাদ চলছে। ধর, আমাদের যুগে কারেন্ট গেলে দু-এক মিনিট পরেই আবার এসে যেত। আর তোদের বাবা যখন ছোট ছিল তখন কারেন্ট গেলে ১০-১৫ মিনিট পরেই আবার চলে আসত।’
বাবা আমাদের ঘরে ঢুকলেন। দাদুকে বললেন, ‘বাবা, সুমন-দীপনের কিন্তু সামনে পরীক্ষা।’ দাদু বলেন, ‘আরে একটু বস। তোর ছোটবেলার গল্প শোনাচ্ছি ওদের।’
‘তুমি শোনাও। আমি আতঙ্কে আছি। আবার কখন কারেন্ট চলে যায়। আইপিএসও তো নষ্ট হয়ে গেল।’ এ কথা বলে বাবা ঘরে গেলেন। মা বাবাকে দেখেই বললেন, ‘তুমি ঘুরঘুর করছ কেন। বসে বসে আমাকে বাতাস দাও।’
সুমন বলল, ‘দাদু, দাদি বেঁচে থাকলে তোমাকে বাতাস দিতে পারতেন।’ এ কথা শুনে বাবা পাশের ঘর থেকে বলেন, ‘সুমন, বেশি কথা বলো না। পড়া শেষ করো।’
দাদির প্রসঙ্গ তোলায় দাদু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
তারপর বললেন, ‘বিবর্তনের কথা যা বলছিলাম। তোদের
সময় কারেন্ট দুই ঘণ্টা করে থাকছে না। একবার গেলে দুই ঘণ্টা পর আবার আসছে। আমাদের সময় এক মিনিট বা দুই মিনিট করে লোডশেডিং। তোর বাবার সময় ১০-১৫ মিনিট
করে লোডশেডিং। আর তোদের সময় দুই ঘণ্টা করে। এই হচ্ছে কারেন্টের বিবর্তনবাদ।’
সুমন খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘আমরা তো বিয়ে করব। আমাদের যখন বাচ্চা হবে তখন?’
পাশের ঘর থেকে মা-বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন।
সম্ভবত সুমনের কথা শুনে ফেলেছেন।
দাদু বললেন, ‘তোর যখন ছেলে হবে তখন এক দিন কারেন্ট থাকবে, আরেক দিন থাকবে না। ধর, শনিবার কারেন্ট থাকলে রোববার থাকবে না। আবার সোমবার থাকলে মঙ্গলবার থাকবে না। এ রকম…।’
আমি দাদুকে বলি, ‘সুমনের বাচ্চার যখন বাচ্চা হবে তখন?’
দাদু বলেন, ‘তখন কারেন্ট এক বছর থাকলে পরের বছর থাকবে না। এক বছর পর পর কারেন্ট আসবে।’
পাশের ঘরে মা-বাবার হাসির শব্দ। দাদুর কথা শুনে
হাসছেন মনে হয়। কিন্তু আমি ও সুমন কল্পনার চোখে
আগামী দিনের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।
সুমন দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দাদু, তাহলে আমি বিয়েই করব না।’
সুমনের কথা শুনে দাদু সুমনকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
বললেন, ‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুমি চিরকুমার থেকো।’
দন্ত্যস রওশন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৭, ২০১০
Leave a Reply