গরম যখন চরমে
বিদ্যুৎ যখন মিসডকল, তখন গরমে অবস্থা চরম হবে—এ বিষয় স্বীকার করতে কারও কোনো শরম লাগার কথা না। সুতরাং মরমের যত ব্যথা তা ঝেড়ে ফেলতে কারও কোনো রাখঢাক নেই। তাই হয়তো সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলেই চলেছেন, এসব জঞ্জাল জোট সরকারের দুর্নীতির ফল, তারা খাম্বা-টাম্বা বানিয়ে দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থার চৌদ্দটা বাজিয়ে ছেড়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিপরীতে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর দল ও সহচরেরা এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, বিদ্যুতের এই মিসডকল ব্যবস্থাপনা মহাজোট সরকারের দুষ্টু পরিকল্পনারই অংশ। এ দেশের জনগণকে বিদ্যুতের অভাবে রেখে দুই নম্বরী সব প্রকল্প পাস করিয়ে ঘুষের অঙ্কে জোশ করার জন্যই তারা দিবারাত্রি লোডশেডিংয়ের তমসা ডেকে জনগণের সঙ্গে তামাশা করছে। যারা রাজনীতির সাতে কিংবা পাঁচেও নেই, সেই জনগণ কিন্তু এসব কথার মারপ্যাঁচে ঘুরপাক খেতে বাধ্য। সরল বিশ্বাসে দুই দলের কথাই সত্য মনে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবু গরমকালে এমন মিসডকল বিদ্যুৎ দেখে পাবলিকের মেজাজ গরম হতে বাধ্য। অতীতে কানসাট থেকে শনির আখড়ার দৌড় সালাহ্ উদ্দিন পর্যন্ত ঘটনায় অনুপ্রেরণার ইতিহাস আছে। আর গরমে যখন আম-কাঁঠাল পাকতে শুরু করেছে, তখন রাজনীতির মাঠে উত্তাপে কমতি থাকার কি কোনো জো আছে? সুতরাং এবারের গরম কাজে লাগিয়ে আন্দোলনের ফল পাকাতে চাইছেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু আবহাওয়ার গরমের সঙ্গে আন্দোলনের গরম ক্রসম্যাচ হবে তো? এই সন্দেহও তাঁর মনে জাগছে। অকালে পাকা আম গাছ থেকে পড়ে যায়। মুক্তাঙ্গন থেকে মাত্র বাংলামোটরে এসে অকালেই পেকে গেছে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি। এখন ঝরে পড়া আমগুলো নিয়ে খালেদা জিয়া যাবেন লংমার্চে। গরমের বিরুদ্ধে বৃষ্টিকে কাছে না পেলে লংমার্চ কতটা লং হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
ধাক্কা কথন
খালেদা জিয়া আরও একবার বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। তখন তিনি সেই সরকারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ তখন তাঁর শক্তিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। নিজের হাঁটুতে ভর করতে না পারলে ধাক্কা দেওয়া যে অসম্ভব, সে কথাও তখন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার তাই ধাক্কার ঘোষণা এখনো আসেনি। তবে রাজশাহীর জনসভা থেকে হরতালের দাবি উঠেছে। খালেদা জিয়া হয়তো খুশিই হয়েছেন। কিন্তু ঝড়ের দিনে আমের দেশে মানুষের আম কুড়াতেই বেশি ব্যস্ত থাকার সম্ভাবনা; হরতালের মতো রোদে পুড়ে ছারখার আন্দোলনে পুলিশের ডান্ডার মুখোমুখি কে হবে? এ সন্দেহ সবার মতোই খালেদা জিয়ার মনেও উঁকি দিয়েছে। তাই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, হরতাল দিলে সফল করতে পারবেন তো? তা ছাড়া এইচ বি এম ইকবালের মতো নেতারাও হরতাল সফল করতে শান্তি মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসবেন কি? এ অবস্থায় হরতালের ধাক্কাটায় বল থাকার কথা নয়।
বল তত্ত্ব
ধাক্কা দেওয়ার আগেই দল ও বল সংহত করতে চাইছেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু তাঁর অরুণ প্রাতের তরুণ দল (জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল) বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ। দলীয় সাধারণ সম্পাদকের বার্ধক্যজনিত ক্লান্তিকর পরিস্থিতি ইউটিউব, ফেসবুক আর ব্লু-টুথে হাস্যরসের উপাদান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলন চাঙা করতে চাই বল। বল সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর স্মর্তব্য, ‘বল-দীর্ঘচ্ছদ বাক্য-মুখ চক্ষুর আরক্তভাব-ঘোরতর ডাক হাঁক,—মুখ হইতে অনর্গল হিন্দী. ইংরাজী, এবং নিষ্ঠীবনের বৃষ্টি,—দূর হইতে ভঙ্গীদ্বারা কিল, চড়, ঘুষা এবং লাথি প্রদর্শন ও সার্দ্ধ তিপ্পান্ন প্রকার অন্যান্য অঙ্গভঙ্গী—এবং বিপক্ষের কোনো প্রকার উদ্যম দেখিলে অকালে পলায়ন ইত্যাদিকে বল বলে’। বলা বাহুল্য, বঙ্কিমবাবু বল অর্থে যেসব উপাদানের প্রয়োগ উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর সবই এখন বিএনপিতে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। সাম্প্রতিক কালের এসব শক্তিমত্তা নিজেদের মধ্যে নর্তন-কুর্দন ছাড়া কিছুই নয়। সিলেটে সাইফুরপন্থী আর ইলিয়াসপন্থীদের মল্লযুদ্ধই বলুন আর ছাত্রদলের সভাপতির রক্তত্যাগই বলুন, সব ক্ষেত্রেই বলের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ কেবল আত্মঘাতী। বিপরীত পক্ষের অবশ্য উদ্যমের কোনো অভাব নেই। সুতরাং এই মুহূর্তে খালেদা জিয়া যদি সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেন, তবে সরকারপক্ষের অকালে পলায়নের সম্ভাবনা কতটুকু, সেটা বলার আগে ভাবতে হবে, বাংলামোটরের মতো প্রতিপক্ষের কোনো উদ্যম ছাড়াই বিএনপির অকালে পলায়নের কথাটাও।
চাই ফরমালিন
অকালে পেকে যাওয়া ফলকে কেবল ফরমালিনই বাঁচিয়ে রাখতে পারে। বিএনপি কি পারবে ফরমালিন দিয়ে হলেও নেতা-কর্মীদের রাজপথে ধরে রাখতে? বহুদিন তো আর পুলিশের জলকামান ব্যবহূত হচ্ছে না। ছাত্রলীগ-যুবলীগাররাও প্রতিপক্ষকে মাঠে না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে কী সব বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে! আর সেখানেই রয়েছে সাফল্যের সোনার পাথর বাটি। অনেকেই বলছেন, সরকার পতনের আন্দোলন সফল করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।
জাতি এখন তাকিয়ে আছে ১৯ তারিখের মহাসমাবেশের দিকে। খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের জ্বালাময়ী হরতাল দেবেন, নাকি চলমান ‘মোটিভেশন প্রোগ্রাম’-এর অংশ হিসেবে লংমার্চকেই বেছে নেবেন? বিবৃতি আর প্রেস কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে এখন বিএনপি লংমার্চ নিয়ে ভাবছে। কিন্তু মার্চ, এপ্রিল পার করে মে মাসে এসেও লংমার্চ পাবলিকে কতটা খায়, সে ভাবনার কারণ আছে। লংমার্চে গরম বেশি, নাকি এলাচি মার্চে, সে বিতর্ক কেবল রাঁধুনির নয়। রান্নায় যেমন গরম মসলা, আন্দোলনেও চাই তার এক পশলা। তবে সেই মসলার ঝাঁজ সইতে না পেরে সাদেক হোসেন খোকা বাবুরা মোটরসাইকেলে মাঠ ছেড়ে অকালে পলায়ন করলেও চিন্তা নেই। সোনার ছেলেরা আছে না?
কাজী মাহমুদুর রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৭, ২০১০
Leave a Reply