আইভান আইভানোভিচ ক্রুতিলকিন পোস্ট অফিসে গিয়ে ঢুকল। সেখানে যে জানালা দিয়ে ডেকে ডেকে চিঠি দেওয়া হয়, তারই সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়াল সে। একটু পরেই জাফরি দেওয়া জানালাটার সামনে এসে দেখল বাদামি চুলের সুন্দরী একটি মেয়ে ওদিকে বসে।
‘পরিচয়পত্রটা চাই।’ মেয়েটি বলল।
শুনেই আইভান হকচকিয়ে গেল, ‘মানে, আমি এখানে মে-ডে-র মেলায় এসেছি। আমার দেশ থেকে চিঠি আসার কথা আছে। আমি—’
‘বলছি, পরিচয়পত্র আছে?
‘আছে।’
‘সেটা দাও কমরেড, দেখি।’
‘এখনই তো সেটা দেখানো যাবে না।’ আইভান জানালার কাছে মুখ নিয়ে নিচুগলায় বলল মেয়েটিকে। ‘কার্ডটা বুটজুতোর তলায় লুকোনো আছে।’
‘তাহলে কোনো উপায় নেই। ওই কার্ড ছাড়া চিঠি দেওয়া নিষেধ।’
‘কিন্তু দেখো, একবার যদি পারো।’
‘না, উপায় নেই।’
‘তার মানে, এখন আমাকে জুতো খুলতে হবে।’
আইভান জানালা থেকে সরে এসে বড় হলটার চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল, বসার কোনো খালি জায়গা নেই। সে তখন কোটটা খুলে মেঝের খানিকটা ঝেড়ে নিয়ে ব্যাগটা পাশে রেখে নিজের ডান পায়ের জুতোটা ধরে টানতে লাগল।
ক্রমেই তার চারপাশে ভিড় জমতে লাগল আর শুরু হলো প্রশ্নবাণ। কী ব্যাপার? জুতো খুলছ কেন?
‘বোধহয় পা-টা মচকে গেছে।’ একজন মন্তব্য করল।
‘কিংবা পায়ে কড়া পড়েছে।’ লোকটা সে জন্য দুঃখিতও।
‘না, না। কড়া নয়। আমার মনে হয় জুতোর মধ্যে কোনো কিছু ঢুকে গেছে।’
ওদিকে জানালার ভেতর দিয়ে সেই বাদামি চুলের মেয়েটিও ইভানের জুতো খোলা দেখছে আর মনে মনে হাসছে। বেচারার কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে জুতো খুলতে। কিন্তু খুলছে না। শেষে আইভান তার বাঁ পা-টা ডান পায়ের জুতোর গোড়ালিতে লাগিয়ে ঠেলা দিতে লাগল। এবার যেন একটু সরল জুতোটা। কিন্তু গোড়ালির কাছে গিয়ে আবার গেল আটকে।
‘না, হলো না।’ ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলল।
‘জুতোর মুখটা চেপে ধরো।’ টুপি মাথায় একজন উপদেশ দিল।
‘জুতোর মুখ চাপলে কী হবে? আমার গোড়ালি গেছে আটকে।’ উত্তর দিল আইভান।
একটি মেয়ে বলল, ‘বুটের ফিতেও তো খোলা যাবে না দেখছি।’
এক ভদ্রলোক, চোখে চশমা, হাতে ছড়ি। আইভানের কাছে এসে তার জুতো ধরে টানতে লাগলেন। অনেকবার হ্যাঁচকা টান মেরেও কিছুই হলো না, মাঝখান থেকে তাঁর চশমাটাই ছিটকে পড়ে গেল। কাজেই ছাড়ান দিয়ে চলে গেলেন তিনি। আর একজন এগিয়ে এল আইভানকে সাহায্য করতে। সেও ব্যর্থ হলো। শেষে একজন লম্বা-চওড়া লোক ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। তার হাত দুটো কোদালের মতো চওড়া, আঙুলগুলো বেশ মোটা। সে বুটটা দুই হাতে কায়দা করে ধরল। লোকেরা ভিড় করে দেখতে লাগল। মুখে তাদের কথা নেই। লোকটা এবার হয়তো আইভানের জুতো পা থেকে ছাড়িয়ে আনবে, নয়তো আইভানের পা-টাই কিংবা দুটোই। ভয়ে আইভান চোখ বুজে ফেলল। জোয়ান লোকটা আইভানের জুতোটা টানতে গিয়ে আইভানকেই মেঝেতে ছেঁচড়ে টানতে লাগল। যতবার টানতে লাগল, ততবারই আইভান মেঝে ঘষটে এগিয়ে এল।
জোয়ান লোকটা বলল, ‘একটা সাঁড়াশি আনো কেউ।’ বলেই আইভানকে টেনে দাঁড় করাল একবার। সে বাঁ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল কিন্তু আবার তাকে ঠেলে বসিয়ে দিল লোকটা। বলল, ‘কই, একটা সাঁড়াশি পাওয়া গেল? আর এক টুকরো কাঠ। একে ধরে আটকে রাখা দরকার।’
কিন্তু পোস্ট অফিসে সে রকম কিছুই পাওয়া গেল না। কাজেই জোয়ান লোকটা প্রায় ১০ মিনিট ধরে আইভানের জুতোসমেত পা-টা ধরে ঘরময় ছেঁচড়ে ঘোরাতে লাগল। সারা ঘরটায় দুবার আইভানকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে জোয়ান লোকটা হাঁপিয়ে গিয়ে বসে পড়ল।
কপালের ঘাম মুছে লোকটা বলল, ‘না, সাঁড়াশি ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
এবার জনা পাঁচেক লোক এগিয়ে এল। তাদের একজন আইভানের জুতোটা ধরল আর বাকি চারজন পর পর একজন এক-একজনের কোমর জড়িয়ে ধরল। তারপর শুরু হলো টান।
দেখে জোয়ান লোকটা খুশি হলো, ‘হ্যাঁ, এভাবে হতে পারে। দাঁড়াও দেখছি।’ বলে উঠে সে পেছন থেকে আইভানের কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টানতে লাগল। বলল, ‘দইদিকে টানো। না, আরও দুজন লোক আমার দিকে দরকার।’ জোয়ান বলল।
তা-ই হলো। জুতো তবু খোলে না।
‘কিরে বাবা। আশ্চর্য তো।’ শেষে ‘হে-ইও’ বলে একটা টান দিতেই জুতো গেল খুলে। লোকগুলো চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। আইভান সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে যার হাতে জুতোটা তখনো ধরা ছিল, তাড়াতাড়ি নিয়ে তার মধ্যে হাত ঢোকাল। কিন্তু কই পরিচয়পত্রটা? একবার সে উঁকি মেরে দেখল জুতোর ভেতরটা। না, নেই। জুতোটা সে তখন উপুড় করে ঝাড়ল। কই? নেই তো!
‘মনে হচ্ছে এই জুতোটার মধ্যে নেই।’ আইভানের স্বর অস্ফুট।
‘কী নেই?’ জোয়ানটা জিজ্ঞেস করল।
‘ভুল জুতোটা খোলা হয়েছে।’
‘তার মানে?’ জোয়ানটার চোখে-মুখে হতাশা।
‘তার মানে বাঁ পায়ের জুতোটাও খুলতে হবে।’
‘বাঁ পায়েরটাও?’ আর কোনো কথা না বলে জোয়ানটা তাড়াতাড়ি কেটে পড়ল সেখান থেকে। আইভান আবার মেঝেতে বসে পড়ল। সে রীতিমতোই ক্লান্ত। আর যেন নড়তে পারছে না।
বাদামি চুলের মেয়েটি এবার চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনারা দেখছেন কী? ওকে একটু সাহায্য করুন।’
এবার ভিড় থেকে বেরিয়ে এল একটা বেঁটেখাটো লোক। এসে আস্তিন গুটিয়ে আইভানের বাঁ পায়ের জুতোটা ধরল। লোকেরা আবার ভিড় করে দেখতে লাগল। আর আশ্চর্য, ছোটখাটো
লোকটি একবার টান দিতেই ফস করে জুতো খুলে এল আইভানের পা থেকে। ভিড়ের লোকগুলো অবাক হয়ে গেল, আর ছোট্ট লোকটি কোনো কথা না বলে সগর্বে বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে চলে গেল।
‘গায়ে কী জোর লোকটির!’ একজন এগিয়ে এসে আইভানকে বলল, ‘আমি ভাবছি ডান পায়ের জুতোটা খুলতে এত মারামারি হলো আর বাঁ পায়ের জুতোর বেলায় এক-দুই-তিন, ব্যস খুলে এল।’
‘কারণটা হচ্ছে, ডান পায়ের জুতোর নম্বরটা ৩৯ আর বাঁ পায়েরটার নম্বর ৪১।’ বলল আইভান।
‘কেন? কেন?’
‘দোকানে কিনতেই আমার ভুল হয়েছিল।’
আইভান বুটজুতো জোড়া বগলে নিয়ে খালি পায়ে আগেকার জানালার কাছে গিয়ে সেখানে মেলে ধরল পরিচয়পত্র, ‘এবার আমার চিঠি দাও।’
মেয়েটি পরিচয়পত্রটা পরীক্ষা করে দেখল, তারপর ডাকের চিঠিগুলো
দেখল খোঁজ করে। পরে উদাস হয়েই বলল, ‘না। ক্রুতিলকিনের নামে কোনো চিঠি নেই।’
এফ কুজনেত্সভ: রুশ লেখক।
অনুবাদ: কুমারেশ ঘোষ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৭, ২০১০
Leave a Reply