মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে যে শব্দটি তার নাম ‘ফ্রি’। সরল বাংলায় অনুবাদ করলে ‘ফ্রি’ মানে দাঁড়ায় ‘ফাও’! ফাও পাওয়াতে বড় আনন্দ! মানুষ এই আনন্দ পেতে পছন্দ করে। আমিও ব্যতিক্রম নই।
চারদিকে প্রতিদিন অসংখ্য ফ্রি-এর অফার দেখি! মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বন্ধ সিম চালু করলে টক টাইম ফ্রি। চোখে পড়ে না এমনভাবে শুধু ছোট্ট করে লেখা থাকে কন্ডিশন অ্যাপ্লাই। বিদেশি জুসের প্যাকেটে অফার থাকে একটা কিনলে একটা ফ্রি! বাসায় আনার পর দেখা যায় পণ্যের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। খেলে বিষক্রিয়া হবে। প্রায়ই কলকাতা যাওয়ার প্লেনের টিকিটের অফার থাকে, একটা টিকিট কিনলে একটা টিকিট ফ্রি! টিকিট আনতে গেলে দেখা যায়, ট্রাভেল ট্যাক্স টিকিটের দামের সমান। নির্দিষ্ট ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পাঁচতারা হোটেলে একজন লাঞ্চ বা ডিনার করলে সঙ্গে একজনের খাবার ফ্রি! অথচ চিঠি দিয়ে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, কোন কোন দিন খাওয়া যাবে না। সুতরাং অচল দিনে ফ্রি খাও। টেলিভিশনে নাটক দেখায়, মুড়ি কিনলে ঠোঙা ফ্রি। এই ঠোঙার মর্ম কী জানি না। এ রকম আরও অসংখ্য ফ্রি-এর ঘটনা আছে। সবগুলোর ক্ষেত্রেই এক ধরনের কৌশলী ফ্রি। স্বার্থ আছে। ব্যবসা আছে! ফ্রি বিষয়টা হচ্ছে লোভ ধরানোর জন্য।
ধানমন্ডি বিভিন্ন রাস্তায় প্রায়ই আমার চলাচল হয়! নাটকের কাজ করি! এর মধ্যে এক ফকিরকে দেখি ভিক্ষা করছেন! ফকিরেরা আল্লাহ-রাসুলের নাম নিয়ে ভিক্ষা করে। কাকুতি-মিনতি করে! এই ফকির বৃদ্ধ। বয়স ৫৫-৬০-এর কম হবে না। চুল বেশির ভাগ পাকা। স্বাস্থ্য ভালো। গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি। ধুলোবালি লেগে কালচে হয়ে আছে। একটা ছালার ওপর বসে ভিক্ষা করছেন! দুই রঙের ফিতার দুটো স্পঞ্জ পাশে রাখা। মুখে আল্লাহ-খোদার নাম নেই। মাঝেমধ্যেই জিকিরের মতো বলছেন, ‘পাঁচ টাকা ভিক্ষা দিলে জ্ঞান ফিরি।’
ভিক্ষুকেরাও যে কিছু দিতে পারে, ফ্রি দিতে পারে এই প্রথম জানলাম। সেটাও আবার ‘জ্ঞান’।
ধানমন্ডিতে এখন অনেক কলেজ ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। ইদানীং বহু ছেলেপেলে আড্ডা দেয় এখানে। এদের অধিকাংশই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন এই ভিক্ষুক বুড়ো। পাঁচ টাকা ভিক্ষার বদলে একটা জ্ঞান উনি ফ্রি দেন। এই জ্ঞান হচ্ছে গাঁজা দিয়ে বানানো সিগারেট!
ভিক্ষুকের নাম খৈয়ম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই কাজটা কি ঠিক করছেন?’
‘অবশ্যই ঠিক। ভিক্ষা দিয়া তারা সোয়াব কামাই করে। সঙ্গে জ্ঞান ফ্রি দিতাছি। এই সিকারেট উচ্চ জ্ঞান বিদ্দি (বৃদ্ধি) করে, ভাবনা বাড়ায়। বুদ্ধি খোলে। যার ইচ্ছা ভিক্ষা দিয়া সোয়াব কামাবে। অসুবিধা আছে?’
নতুন যারা খেতে এসেছে এরা ক্যামেরা দেখলে একটু ভয় পায়। খানিকটা লজ্জাশীল। অভ্যস্ত গাঁজাখোরেরা হয় বেশরম। নির্লজ্জ ও বেহায়া। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেপেলেতে লেকের সুস্থ পরিবেশ নোংরা হচ্ছে—এই অভিযোগ স্থানীয়বাসিন্দাদের। তরুণদের মধ্যে গাঁজা বা এজাতীয় নেশার প্রতি আকর্ষণ আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এটা ঘটছে, সেটা চিন্তার ব্যাপার!
‘ভিক্ষা দিলে জ্ঞান ফ্রি’ তত্ত্বটা নিয়ে একটি দৃশ্য তুলে ধরছি! দৃশ্যের চরিত্রগুলো কাল্পনিক!
করম আলী ও রুস্তম খান বসে আছেন। ভিক্ষুক ফোন করেছে। করম আলীর সঙ্গে কথা বলছে।
ভিক্ষুক: সালামালাইকুম, স্যার!
করম আলী: অলাইকুম আসসালাম। কেমন আছ?
ভিক্ষুক: ভালো আছি, স্যার!
করম আলী: তোমার ভিক্ষা-জ্ঞান বিতরণের কাজ কেমন চলতাছে?
ভিক্ষুক: আপনের দোয়ায় ভালো, স্যার!
করম আলী: শোনো, সব সময় একই ইউনিভার্সিটির কাছে বসবা না। এখন অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি! মেডিকেল কলেজ… একেক দিন একেক জায়গায় বসবা!
ভিক্ষুক: আমার একটা ভাইগ্না আছে স্যার, কোনো কাজ করতে পারে না! তারও যদি একটা ব্যবস্থা নিতেন…।
করম আলী: ভাইগ্না ভাইস্তা আত্মীয়স্বজন কানা ল্যাংড়া যা আছে নিয়া আসো। কাজের ব্যবস্থা কইরা দিব।
ভিক্ষুক: শুকরিয়া, স্যার। শুকরিয়া। [খুশি মনে রাখবে]
রুস্তম খান জিজ্ঞেস করল, কে স্যার?
করম আলী: এক ভিক্ষুক! তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি।
রুস্তম খান: আমি, স্যার। বড় ভয়ের মধ্যে আছি। এইবার আমাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার মনে হয় হয়েই যাবে, স্যার!
করম আলী: তুমি যে রকম ভয় পাচ্ছ তাতে তো আমারই এখন শরম লাগছে এটা চিন্তা করে যে তুমি ১৯৭১ সালে আল-বদর বাহিনীতে ছিলে।
রুস্তম খান: চারদিকের অবস্থা দেখছেন, স্যার…।
করম আলী: দেখছি, কী হয়েছে?
রুস্তম খান: তরুণ প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা আমাদের বিচার চায়, স্যার…।
করম আলী: আরে বেওকুফ, যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে, সেই ভয়ে চিকার পিছছাবে আছাড় খাব?
রুস্তম খান: সেই সময় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা না করলেই হতো, স্যার। এত বছর পরে আজ…।
করম আলী: শোনো, ওই সময় বুদ্ধিজীবীদের যদি হত্যা না করা হতো তাহলে স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাপরাধের জন্য আমাদের বিচারের দাবি উঠত। বুদ্ধিজীবীদের খতম করায় আমরা এত দিন বিপদমুক্ত ছিলাম। এখন তোমাকে চিন্তা করতে হবে এত দিন পর যুদ্ধাপরাধের বিচারটা কারা বেশি চাইছে?
রুস্তম খান: কারা আবার, আওয়ামী লীগ।
করম আলী: দূর পাগল! আওয়ামী লীগ তো বিষয় না। আওয়ামী লীগ তখনো ছিল। ১৯৯৬-এও ছিল। তাতে কী হয়েছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্ররা লাফালাফি করছে বেশি। বুদ্ধিজীবীদের মতো এদের লাফালাফি খতম করে দিলেই আমরা নিরাপদ!
রুস্তম খান: কিন্তু এখন এসব খুনোখুনি করা…..
করম আলী: রক্তের খুনোখুনি তো ছাত্রলীগ নিজেরাই করছে। পেপার দেখো না! ওই সব রক্তারক্তি কাণ্ড করার দরকার আমাদের নেই। আমাদের এখন যেটা করতে হবে সেটা হলো শিক্ষিত তরুণ ছেলেমেয়েগুলোর জ্ঞানকে খুন করতে হবে, মেধাকে হত্যা করতে হবে! তাহলেই আমরা নিরাপদ হতে থাকব!
রুস্তম খান: কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব, স্যার?
করম আলী: বাংলাদেশে এখন কলেজ-ইউনিভার্সিটির অভাব নেই। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আমি অলরেডি ভিক্ষুকদের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে ‘পাঁচ টাকা ভিক্ষা দিলে জ্ঞান ফ্রি’ প্রজেক্ট চালু করেছি! এটা চালু করে খুব ভালো ফল পাচ্ছি!
রুস্তম খান: মানে, স্যার?
জ্ঞান ফ্রি… বিষয়টা বুঝলাম
না!
করম আলী: এটা হচ্ছে একের ভেতর দুই। ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান করছি। এতে সরকারের ঘরে ঘরে কর্মসংস্থানের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে সাহায্য করছি! দুই. তরুণদের মেধা খুন করছি। গাঁজার নেশায় তারা চিন্তাশূন্য হবে। তাতে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে থাকবে। গিভ অ্যান্ড টেক! ‘ভিক্ষা দিলে জ্ঞান ফ্রি’ আলো চারদিকে ছড়িয়ে দাও!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১০, ২০১০
Leave a Reply