লাল সার্টিনের টাইতে বিংগোকে একেবারে কিম্ভূতকিমাকার দেখাচ্ছিল।
‘হ্যালো, বার্টি!’
‘হাই, বিংগো। টাই পরে, ফুলবাবুটি সেজে! কী ব্যপার?’
‘এটা গিফট পেয়েছি।’ লাজুক হেসে বলল বিংগো।
দুজন কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটলাম। তারপর একটা চেয়ারে বসতে বসতে বিংগো বলল, ‘আচ্ছা, ম্যাবেল নামটা কেমন?’
‘ভালো না।’
উত্তরে বিংগো একটু কষ্ট পেল যেন।
‘কে সে?’ নরম সুরে বললাম আমি।
‘কালকে আমার সাথে লাঞ্চে চল। পরিচয় করিয়ে দেব।’
পরদিন একটা চায়ের দোকানে বিংগো ম্যাবেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে। ‘ওর মতো সুন্দর মেয়ে তুই আর একটিও দেখেছিস?’ ম্যাবেল চলে যাওয়ার পর বিংগো প্রশ্ন করল আমাকে।
‘আলবৎ না। আচ্ছা, ওর সঙ্গে তোর পরিচয় হলো কী করে?’
‘ক্যামবারওয়েলের নাচের পার্টিতে। জিভস নিয়ে গিয়েছিল।’
‘জিভস? ও আবার পার্টিতেও যায় নাকি?’
‘যা-ই হোক, বার্টি, আমাকে একটু সাহায্য কর। আমার ইচ্ছে করছে জিভসকে আমার সমস্যাটা খুলে বলতে। তুই তো বলিস ওর অনেক বুদ্ধি। ও নাকি তোর অনেক বন্ধুকে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছে।’
‘আগে সমস্যাটা তো শুনি।’
‘আরে, সমস্যাটা হলো আমার বুড়ো চাচা। আমার তো আর কেউ নেই। চাচাও বিয়েথা করেনি। উনি যদি জানতে পারেন যে ম্যাবেল একজন চায়ের দোকানদার, সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাকে টাকা-পয়সা দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেবেন। তুই, প্লিজ, জিভসকে বল একটা বুদ্ধি বের করতে, যাতে চাচা ম্যাবেলের সঙ্গে আমার বিয়েতে রাজি হয়।’
সেই রাতে ডিনারের পর কথাটা পাড়লাম জিভসের কাছে, ‘জিভস, একটা সমস্যা হয়েছে।’
‘কী সমস্যা, স্যার?’
‘সমস্যাটা বিংগো আর তার চাচাকে নিয়ে। বিংগো এক চায়ের দোকানের কর্মচারীকে ভালোবাসে, কিন্তু ওর চাচাকে বলতে পারছে না।’
‘ও। মানে ওনার যে চাচা পাউন্সবি গার্ডেনে থাকেন, মিস্টার লিটল?’
‘তুমি এত সব জানো কী করে?’
‘আসলে, স্যার, মিস্টার লিটলের রাঁধুনির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। সেদিন শুনলাম লিটলের এক কর্মচারী নাকি ওনাকে প্রতি রাতে সাহিত্য পড়ে শোনায়। আমার মনে হয় বিংগোর নিজেরই উচিত ওনার চাচাকে পড়ে শোনানো। এমন বই, যেগুলোতে দুজন অসম সামাজিক অবস্থানের মানুষের বিয়ে হয়। যেমন, আ রেড, রেড সামার রোজ। আমি জোগাড় করে দেব। দেখবেন, স্যার, এগুলো শুনলে লিটল একেবারে গলে যাবেন। চায়ের দোকানদারের সঙ্গে নিজের ভাতিজার বিয়েতে আর কোনো আপত্তিই করবেন না।’
কাজেই জিভসের পরামর্শমতো বিংগো প্রতি সন্ধ্যায় তার চাচাকে বই পড়ে শোনাতে লাগল। একপর্যায়ে বেচারা গলা গেল ভেঙে। বেচারা গলা!
কদিন পরই বিংগো এসে হাজির।
‘দোস্ত, আমার চাচা তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
‘আমার সঙ্গে? উনি তো আমাকে চেনেনই না।’
‘আরে, আমি বলেছি তো, তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু।
‘তোর মতলব কী রে?’
‘মানে, চাচাকে আমি ম্যাবেলের কথাটা বলতে ভয় পাচ্ছি। তুই যদি…।’
‘আমি? মাথা খারাপ?’
‘দেখ, আমি কিন্তু একবার তোর জীবন বাঁচিয়েছিলাম।’
‘কবে রে?’
‘অ্যা…অ্যা…নাহ্! তাহলে মনে হয় অন্য কারো। অত সব বুঝি না। কালকে চলে আসবি।’
অগত্যা পরদিন গেলাম মি. লিটলের বাড়ি।
‘আসুন, আসুন। কী সৌভাগ্য আমার!’ আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন মি. লিটল, ‘অল্প বয়সেই কত উন্নতি করে ফেলেছেন। বেশ বেশ।’
আমি ভাবলাম, লিটল হয়তো আমাকে অন্য কারও সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। এমন সময় একটা কাজের মেয়ে এসে বলল, আমার একটা ফোন এসেছে। ওপাশ থেকে বিংগোর গলা শোনা গেল।
‘হ্যালো, চাচা তোকে দেখে খুশি তো?’
‘একটু বেশিই খুশি মনে হলো।’
‘দোস্ত, তোকে একটা কথা বলা হয়নি। চাচাকে বলেছি, তুই ওই বইটির লেখক।’
‘কী?’
ফাজিলটা খট করে ফোন রেখে দিল।
মি. লিটলের সঙ্গে আমার লাঞ্চ যেন আর শেষই হতে চায় না।
‘এত সুন্দর লেখেন আপনি, পড়লেই চোখে পানি চলে আসে। আমিও একসময় শ্রেণীবৈষম্যে বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আপনার বই পড়ার পর…।’
অবশেষে আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘বিংগো চায়ের দোকানের একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।’
‘খুব ভালো।’
‘আপনি রাজি?’
‘অবশ্যই।’
একটু দম নিয়ে বললাম, ‘মানে, আপনি যা হাতখরচ দেন তাতে ওর নিজের চলে যাচ্ছে। কিন্তু…।’
‘আমি দুঃখিত। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমার স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা হবে।’ মাথা নেড়ে জানালেন মি. লিটল।
‘কিন্তু, আপনি তো বিয়েই করেননি।’
‘করব। যে মহান নারী আমাকে এত দিন রেঁধে খাইয়েছে, আমি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।’
‘মি. বিংগো আজ অনেকবার ফোন করেছেন।’ আমি বাড়ি ফেরার পর জিভস বলল।
‘তোমার জন্য খারাপ খবর আছে, জিভস। তোমার বাগদত্তা তার মনিবকে বিয়ে করছে।’
‘সত্যি, স্যার?’ ‘তুমি কষ্ট পাচ্ছ না?’
‘স্যার, আমি জানতাম এমনই হবে।’
‘তাহলে কেন এই বুদ্ধি আঁটতে গেলে?’
‘আসলে, স্যার, আমার মনে হচ্ছিল আমি অন্য আরেকজনের দিকে ঝুঁকে পড়েছি।’
‘মানে? কত দিন ধরে চলছে এসব?’
‘কয়েক সপ্তাহ। যেদিন ওকে প্রথম ক্যামবারওয়েলের পার্টিতে দেখলাম…।’
‘হায়! হায়! বলে কী!’
‘ঠিকই ধরেছেন, স্যার। কাকতালীয়ভাবে সেই মেয়েটিই, যে আপনার বন্ধু। স্যার, আপনার সিগারেটগুলো ছোট টেবিলে রেখেছি। শুভ রাত্রি।’
পি জি ওডহাউজ
অনুবাদ: আলিয়া রিফাত
পি জি ওডহাউজ: ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও গীতিকার। জাতে ব্রিটিশ। তার বিখ্যাত সৃষ্টি মজার চরিত্র জিভস। জন্ম ১৫ অক্টোবর, ১৮৮১; মৃত্যু ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১০, ২০১০
Leave a Reply