বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়ংকর পার্টি কোনটি—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, না জাতীয় পার্টি? উত্তর কোনোটিই না। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে এখন অজ্ঞান পার্টি। এর সঙ্গে মলম পার্টি, মরিচগুঁড়া পার্টি এবং বগুড়ায় সুঁই পার্টি!
মলম পার্টি ও মরিচগুঁড়া পার্টি মানুষের চোখেমুখে মলম মেখে দেয়, মরিচ ডলে দেয়। আর সুঁই পার্টি আকস্মিকভাবে কোমরের নিচে পেছন দিকে বড় সুঁই দিয়ে গুঁতো মারে। আক্রান্ত ব্যক্তি ‘উহ-আহ’ বলে সেদিকে মনোযোগী হয়। হাত ব্লক হয়ে পড়ে। তত্ক্ষণাত্ সুঁই পার্টি পকেটের পার্স বা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। সম্পদ খোয়া গেলেও এতে মৃত্যুর ঝুঁকি কম!
আগে ঈদ-পূজাজাতীয় উৎসবগুলোর আগে অজ্ঞান পার্টির আক্রমণ হতো। এখন সারা বছরই এই উৎপাত চলে।
অজ্ঞান পার্টি নামে একটি নাটক করতে গিয়ে এই দলের সদস্যদের খুঁজছিলাম অনেক দিন। উচ্চপর্যায়ে বলে রেখেছিলাম। অবশেষে একদিন সেই সোর্সের ফোন এল। আমি অজ্ঞান পার্টির সর্দারের সাক্ষাত্ পেলাম। তাঁর নাম চান মিয়া পণ্ডিত। বয়স ৫২-৫৩। ‘পণ্ডিত’ তাঁর উপাধি।
চান মিয়া পণ্ডিতকে দেখে হতাশ হলাম। হ্যাংলা-পাতলা গায়ের গড়ন। চাপা ভাঙা। ঠোঁটের ওপর চিকন গোঁফ। পাক ধরেছে। শুকনো স্বাস্থ্য। অতি নিরীহ চেহারা। পরনে সাদা ময়লা লুঙি। ঘিয়ে রঙের ফুলশার্ট। বুকের বোতাম ছেঁড়া। পায়ে স্যান্ডেল নেই। এই লোক মানুষ অজ্ঞান করার ওস্তাদ—কেউ কল্পানাও করতে পারবে না।
উপস্থিত একজন জানালেন, ইনি শুধু ওস্তাদ না, মানুষকে অজ্ঞান করার নিত্যনতুন ফাঁদ অবিষ্কার করেন বলে তাঁর নামের সঙ্গে ‘পণ্ডিত’ উপাধি যুক্ত হয়েছে।
তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করলাম। চান মিয়া পণ্ডিত ছিলেন রিকশার মিস্ত্রি। ঢাকাতে যারাই আসে, সবারই প্রধান টার্গেট বড়লোক হওয়া, বড়লোকদের সঙ্গে থাকা। একটি বাড়ি করা, না হলে অন্তত একটা প্লট কেনা বা দু-চার কাঠা জায়গা করা। চান মিয়ার সঙ্গে মুনতুর মিয়া নামের এক ব্যক্তির সখ্য ছিল। তাঁরও টার্গেট ঢাকায় একটা বাড়ি বা জায়গা করা। শেষে বুঝলেন, সেটা সম্ভব না। তবু তাঁর ঢাকায় থাকতে হবে। তিনি ভিক্ষা করে বনানীতে একটা কবর কিনে ফেললেন। মরার পরে অন্তত বড়লোকদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে থাকা যাবে—এ আশায়। তবু ঢাকায় থাকা! বিভিন্ন হাউজিং ও ডেভেলপার কোম্পানিগুলোও মানুষের এই কষ্টগুলোর কথা চিন্তা করে। তাই তারা নদী-নালা, খাল-বিল যেখানে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে। দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কিস্তিতে প্লট দেওয়ার লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। অনেকে সেসব কিনে গোলও খেয়েছে।
চান মিয়া পণ্ডিতের আকাঙ্ক্ষাও উচ্চ। কিন্তু রিকশামিস্ত্রির আয়ে তাঁর পোষাত না। সঙ্গে বউয়ের চাপ! আয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবে তিনি রিকশা চুরি শুরু করলেন। চুরির আগে রিকশাওয়ালাদের চা-বিস্কুট খাইয়ে অজ্ঞান করা শুরু করেন।
জিজ্ঞেস করলাম, চা-বিস্কুটে কী মেশান? বিষ?
‘নাহ! দামি ওষুধ দেই। ইয়েত এটিভেন। মেড ইন পাকিস্তান। ঘুমের অষুধ। গুঁড়া কইরা মিশায়া দেই। খাওয়ার একটু পরেই বেহুঁশ! জন্মের ঘুম দেয়। ছয়-সাত ঘণ্টায়ও ঘুম ভাঙ্গে না।’
অজ্ঞান পার্টির খাবার খেয়ে অনেকেই মারা গেছেন। পত্রিকায় পড়েছি।
চান মিয়া পণ্ডিত বললেন, ‘কাহিনি সত্য। ডোজের পরিমাণ বেশি হইলে মওত ঘটে। আসলে হায়াত শ্যাষ হয়া গেলে তো কারোর কিছু করার থাকে না। সিদ্ধান্ত আল্লাহপাকের! আমগো অষইধ হইল উছিলা! দোষ পড়ে অজ্ঞান পার্টির!’
প্রধানত চা, ক্রিমঅলা বিস্কুট, খোসা ছিলে ধুয়ে দেওয়া শসা-আমড়া ইত্যাদি, ঝালমুড়ি, আখের রস, ফালি করে কাটা তরমুজের সঙ্গে অজ্ঞান করার ওষুধ মেশানো থাকে। ছোটখাটো এসব দোকানির অনেকেই অজ্ঞান পার্টির সদস্য।
পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর যন্ত্রণায় অজ্ঞান পার্টি তাদের কৌশলেও নিত্যনতুন বদল ঘটাচ্ছে। আগে শুধু বড়লোকদের টার্গেট করা হতো। তাতে পত্রিকায় রিপোর্ট হতো। টেলিভিশনের খবরে ছবি দেখাত। ঝামেলা সৃষ্টি হতো। গত দুই রমজান আগে থেকে অজ্ঞান পার্টি ভিক্ষুক এবং গ্রাম থেকে আসা গরিব মানুষদের টার্গেট করছে। গরিব মানুষের মধ্যে গ্লামার নেই। ফলে মিডিয়ারও আগ্রহ নেই। ঝামেলা কম।
আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর নাম শাহজাদা। সে একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। স্মার্ট, সতর্ক ও সাহসী। অফিস থেকে বাসে করে মতিঝিল আসছিল। বাইরে প্রচণ্ড গরম। পিপাসায় সে কাতর। ফার্মগেটে গাড়ি থেমেছে। আনন্দ সিনেমার কাছে ডাব নিয়ে এক বৃদ্ধ দাঁড়ানো। সব ডাবের মুখ কাটা। কিছু মিশিয়ে রাখতে পারে এই আশঙ্কায় শাহজাদা জিজ্ঞেস করল, ফ্রেশ ডাব কেটে দেওয়া যাবে কি না।
বৃদ্ধ বললেন, অবশ্যই যাবে। দ্রুত ডাব কেটে দিলেন। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে চলন্ত গাড়িতে খুব আরাম করে শাহজাদা ডাব খেল। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। হুঁশ ফিরল তিন দিন পরে। তখন সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুয়ে আছে। জান ছাড়া তার সব খোয়া গেছে।
এটি অজ্ঞান পার্টির নতুন উদ্ভাবন। অক্ষত ডাবের ভেতর বিশেষভাবে ওষুধ মেশানো! চলন্ত গাড়ি বা ফেরির যাত্রীদের টার্গেট করা। ডাব বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান পার্টির মোবাইল টিমের দুই-তিন সদস্য ওই গাড়িতে উঠে যায়। সুবিধামতো জায়গায় অপারেশন চালায়। কিছু গাড়ির হেলপার-ড্রাইভারও এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত!
চান মিয়া পণ্ডিত বললেন, তাঁর একটা নাটক গ্রুপও আছে। সেইখানে ভালো পোশাক পরা ছেলেমেয়েরা কাজ করে। রাস্তার মধ্যে নাটক করে মানুষকে ফাঁদে ফেলে!
চিরকাল শুনে এসেছি, নাটক সমাজ বদলের হাতিয়ার। বাংলাদেশে নাটকও এখন অজ্ঞান পার্টির হাতিয়ার!
নাটক পার্টির মেয়েরা প্রেমের অভিনয় করে প্রধানত রিকশাচালক, সিএনজিঅলা এবং ক্যাবচালকদের ফাঁদে ফেলে!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ যে আপনাকে ধরে, আপনার বিচার হয় না?
চান মিয়া খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘এই নিয়া সাতাইশবার ধরল। ছাব্বিশবার ছাড়া পাইছি! আইন দিয়া আমারে আটকাইতে পারে নাই। দোষী করতে পারে নাই!’
কিন্তু আসলে তো আপনি নির্দোষ না।
‘পাবলিক আর পুলিশ আমারে দোষী বললে তো হবে না। বাংলাদেশের আদালত বলছে, আমি নির্দোষ! আমারে কেউ দোষী বললে আদালত অবমাননার মামলা হওয়া দরকার।’
প্রসঙ্গ বদল করে বললাম, কত নিরীহ মানুষকে আপনি বিপদে ফেলেছেন! আপনার কখনো খারাপ লাগে না? আপনার বউ-ছেলেমেয়েরা কি জানে আপনি এই কাজ করেন?
চান মিয়া বেশ খানিক চুপ করে রইলেন। বললেন, ‘এত কিছু করছি বউরে খুশি করতে। বউয়ের মন পাইতে কামাই কইরা পয়সা ঘরে নিয়া গেছি। কিন্তু কেমনে কেমনে জানি বউয়ের লগে ঝগড়া হয়্যা যায়। মারামারি লাইগা যায়। শ্যাষে বউ বদল করলাম। তিনবার বিবাহ করলাম। তবু সংসার টিকল না। বড় অশান্তি। তাই ঠিক করছি, আমিই যুুদি অশান্তিতে থাকি, মাইনষেরে শান্তিতে থাকতে দিব ক্যান?’
পুনশ্চ: সর্বশেষ তথ্য হলো, চান মিয়া পণ্ডিত ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। আবারও আদালতে গিয়ে ছাড়া পেয়েছেন কি না জানি না।
আবু সুফিয়ান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৩, ২০১০
Leave a Reply