বাঘ চিরকাল নির্জন বনবাসী। দিব্যি ছিল বনের এক কোণে নিজের মনে নিরিবিলি। মানুষের মনগড়া বন্যেরা বনে সুন্দর সবককে তারা বসবাসের জন্য মডেল হিসেবে অন্তর থেকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এক গাঁয়ের এক চাষার হাড়হাভাতে অলস ছেলের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে গিয়ে বাঘের গহিন বনের নিশ্চিন্ত আবাস এক লহমায় তছনছ হয়ে গেল। বনবাসী বাঘ উদ্বাস্তু হয়ে এখন স্থায়ীভাবে মনবাসী। বনের বাঘ আবাস বদল করে হয়ে গেল মনের বাঘ। মনের বাঘের গল্পটা আজ বেশ ঘটা করে পুরোনো ঢংয়েই বলে ফেলি।
অনেক অনেক দিন আগের কথা। একদা এক গাঁয়ে এক ছিল চাষা। চাষা মানুষটা দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাঠে ফসল ফলায়। এদিকে তার বেহদ্দ আলসে ছেলেটা গায়ে খাটার কথা শুনলেই হাত-পা ছেড়ে আঁতকে উঠে বলে, ‘অসম্ভব! গতর খাটিয়ে পেটের ভাত জোটানো! কভি নেহি।’
বুক ফুলিয়ে তাতে টক করে টোকা দিয়ে বলে, ‘আমি হবু পলিটিশিয়ান। বিনা খাটুনিতে স-ব-কি-ছু তুড়ন্ত তৈরি সামনে হাজির না হলে পলিটিকসের তেলেসমাতির আর রইল কী? গতর খাটিয়ে ভাগ্য গড়া সে তো আমজনতার ছোটলোকি কায় কারবার। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ মনের কোণে জ্বালিয়ে নিয়েই পলিটিশিয়ান দুনিয়ার বুকে পা রাখে। মুখ ফুটে নয়, ‘আমি মনে মনে যা চাইব, তা-ই পাব।’
এমন দুর্দান্ত পলিটিশিয়ানের বাপ মানুষটা গতর খাটা গেঁয়ো চাষা। বিটকেলে ছেলের ভাবনাচিন্তার এমন ভীষণ গতিকে বাপ মানুষটা সারাক্ষণ ভয়ে খাবি খায়। বোকাসোকা মানুষটা ইতিউতি হরেক ভাবনায় মনে মনে ছেলের নিদানের উপায় খোঁজে। উপায়ান্তর না পেয়ে একদিন ছেলের হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে সাধু বাবার থানে গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়ে। ডুকরে কেঁদে আকুল হয়ে বলে, ‘বাবাগো, রক্ষা করো।’ বহুদর্শী সাধু বাবা পলিটিশিয়ান ছেলের মন খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলে, মুখে মারফতি হাসি ফুটিয়ে ঝটিতি নিদান বাতলে দেয়। বলে, ‘শোনো হে ছোকড়া। নারকেল জিঞ্জিরা থেকে তেঁতুলিয়া, তামাম দেশের স্থাবর-অস্থাবর তাবত্ সম্পত্তি আমার আমার বলে নিজ দখলে কবজা করতে চাইলে তোমার মনঃসিদ্ধি সাধনা দরকার। বনের গহিনে নির্জনে পাঁচ বছর কঠিন তপস্যা করো। তোমার কঠোর তপস্যার তেজে গণদেবতার আসন একদিন তেতেপুড়ে জ্বলে উঠবে। সেই বেলা গণদেবতা হাত তুলে বলবে তথাস্তু। তখন তোমার মনঃসিদ্ধি সাধন পূর্ণ হবে। সেদিন থেকে তুমি মনে মনে যা ভাববে তা-ই হবে। যাও বাছা, এবার তুমি বনের পথ ধরো।’ দিন-মাস-বছর গড়িয়ে পাঁচ বছর একদিন পার হয়ে যায়। সাধন মগ্ন চাষার ছেলের জান ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যখন যায় যায়, তখন গণদেবতার চৈতন্যোদয় ঘটে। হাতখানা কিঞ্চিত্ উঁচিয়ে গণদেবতা আলগোছে বলে, ‘তথাস্তু। আজ থেকে তুমি মনে মনে যা ভাববে তা-ই হবে।’
আহ্। শান্তি! কঠোর সাধনার গাছে আজ টাটকা তাজা ফল! পাঁচ বছরের কঠোর সাধনায় পলিটিশিয়ান ছেলের গায়ে কখানা জিরজিরে হাড়, ক্ষুধায় পেট পিঠের সঙ্গে। ওর গাও-গতর, মন-মগজজুড়ে শুধু খাই খাই রব। সাধনসিদ্ধ ছেলে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো মেলে বলে, ‘এক নম্বর খাস খতিয়ানের এই বন আজ থেকে আমার হোক। বনের কোণে ভারি খাসা আমিরি চালের একখানা বাগানবাড়ি হোক।’ সে বাড়ির মেঝেতে কলোনিয়াল আসবাব-জানালায় ভিক্টোরিয়ান পর্দা-টেবিলে মোগলাই খানার ছড়াছড়ি। পাঁচ বছরের হারানো সুুখ এক লহমায় তার হাতের মুঠোয়। চাষার ছেলে হরেক পদের খানাখাদ্যে ভরপুর পেটে পালকের বিছানায় খানিক গড়ান কেটে ভাবে, এত সুখ জীবনে সইবে তো? এমন নির্জন গহিন বনে আমি একলা একটি প্রাণী। বন থেকে কোনো বাঘ আচানক ঘরে ঢুকে আমাকে কচমচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে না তো?
পলিটিশিয়ানের পোড়া কপাল। সিদ্ধি লাভ করে বেচারা ভুলে গেল সে সাধনসিদ্ধ। মনে মনে যা ভাববে, তা-ই হবে। এক লহমায় মন ফুঁড়ে ভয়ংকর হিংস্র বাঘ নখ-দাঁত মেলে তার সামনে হাজির। চোখের পলকে বাঘ সাধনসিদ্ধ পলিটিশিয়ানকে হাড়গোড়সুদ্ধ কমমচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।
তারপর থাবায় লেগে থাকা রক্ত-মাংস চেটেপুটে খেতে খেতে বাঘ ভাবল, বসবাসের জন্য বাদাবনের ঝুট-ঝামেলায় ফিরে গিয়ে লাভ কী! মানুষের মনের ঘর একটু নোংরা হলেও খানাখাদ্য হাতের কাছে মজুদ পাওয়া যায়। বাদাবনে দিনভর হাপুস দৌড় শেষে একটা চারপেয়ে মেরে খাওয়ার চেয়ে মানুষের মনের ঘরে বসবাস শেষে নির্বোধ দোপেয়েটাকে টক্ করে ধরে কামড়ে চিবিয়ে খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দেওয়া মেলা সোজা কাজ। যে কথা, সেই কাজ। সেদিন থেকে বাঘ বনের বাস ভুলে গিয়ে মানুষের মনের ঘরে স্থায়ী আবাস গড়ে নিয়েছে।
তুষার কণা খোন্দকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৩, ২০১০
Leave a Reply