৮ নভেম্বর ছিল আমার জন্মদিন। এই দিনটা ভালোভাবে উদ্যাপন করার ইচ্ছা ছিল, যাতে এটা স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাই সম্পূর্ণ অপরিচিত কারও সঙ্গে আলাপ করার কথা ভাবলাম আমি। দিনটা উদ্যাপনের এটাই সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মনে হলো।
তখন ঘড়িতে সম্ভবত ১০টার মতো বাজে। ফ্লোরিডা অ্যান্ড কর্ডোবা হোটেলের এক কোনায়, পরিপাটি পোশাক পরা এক বুড়ো ভদ্রলোককে থামালাম। তাঁর বয়স প্রায় ৬০ বছর। তাঁর ডান হাতে একটা ব্রিফকেস আর চোখেমুখে আইনজীবী এবং নোটারিদের মতো একটা হামবড়া ভাব।
আমি কণ্ঠে মধু ঢেলে বললাম, ‘শুনছেন, স্যার। বলতে পারবেন, পাজা ডি মায়োতে কীভাবে যেতে হবে?’
বুড়ো লোকটি আমাকে ভালোমতো নিরীক্ষণ করলেন একবার। তারপর বললেন, ‘আপনি কি পাজা ডি মায়োর দিকে যেতে চান, নাকি অ্যাভেনিডো ডি মায়োর দিকে?’
‘আসলে…যদি সম্ভব হয়, তাহলে আমি পাজা ডি মায়োর দিকে যেতে চাইছিলাম।’
আমার দিকে না তাকিয়েই তিনি দক্ষিণ দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘আচ্ছা, তাহলে এই পথে যান। ভিয়ামন্ট পার হয়ে টুকুমান, লাভালি…।’
বুঝতে পারলাম, পাজা ডি মায়োতে যেতে যে রাস্তাগুলো পার হতে হবে সেগুলোর নাম তিনি একে একে বলতে যাচ্ছেন। তাই তাঁকে থামানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। বললাম, ‘আপনি ঠিক ঠিক বলছেন তো?’
‘অবশ্যই!’
‘আপনার কথায় সন্দেহ করার জন্য মাফ করবেন।’ এবার পাজা সান মার্টিনের দিকে দেখিয়ে বললাম, ‘কিন্তু কিছুক্ষণ আগে এক বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার লোক বললেন, পাজা ডি মায়ো নাকি উল্টো দিকে।’
বুড়ো বেচারা বললেন, ‘ওই লোকটি তাহলে এ শহর চেনে না।’
‘হতেই পারে না। বললামই তো, তার চেহারা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। আর সত্যি বলতে কি, আপনার চেয়ে তাকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল।’
‘আপনি কি বলতে চাইছেন, আমার চেহারা একটা গাধার মতো?’
আমি বললাম, ‘ছিঃ ছিঃ! না না! আমি এ কথা কখন বললাম!’
‘ওই লোকটার চেহারা বুদ্ধিদীপ্ত—এ কথাটা যখন থেকে বলা শুরু করেছেন, তখন থেকে…।’
‘ও আচ্ছা। কিন্তু সত্যিই বলছি, ওই লোকটাকে দেখতে খুবই বুদ্ধিমান বলেই মনে হচ্ছিল।’
এবার বুড়ো অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে আর সময় নষ্ট না করে আমি বরং যাই।’
‘ঠিক আছে, যান। কিন্তু আমি পাজা সান মার্টিনে কীভাবে যাব, বলে গেলেন না তো?’
এবার তাঁর সারা মুখে বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ল।
‘কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আপনি তো জানতে চাইছিলেন পাজা ডি মায়োতে যাওয়ার পথ?’
‘কই, না তো! আমি তো পাজা সান মার্টিনে যাওয়ার পথ জানতে চাইলাম। পাজা ডি মায়ো নিয়ে তো একটা কথাও বলিনি।’
এবার উল্টো দিকে নির্দেশ করে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, সে ক্ষেত্রে এই দিকে যান।’
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘আপনি দেখছি আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বেন! কিছুক্ষণ আগে দক্ষিণ দিকে যেতে বললেন, এখন আবার উল্টো দিকে যেতে বলছেন?’
‘কারণ, আপনিই তো প্রথমে পাজা ডি মায়োতে যাওয়ার পথ কোনটা জানতে চাইলেন।’
‘অসম্ভব! আমি কখনোই পাজা ডি মায়ো নিয়ে কোনো কথা বলিনি! এ কথা বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। আপনি হয়তো আমার কথা ঠিকমতো বোঝেননি, নইলে আপনি এখনো ঘুমিয়েই আছেন।’
এবার বুড়ো রেগে লাল হয়ে গেলেন। খেয়াল করলাম, তিনি ডান হাতে ব্রিফকেসটা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলেন। আর একটা কথাও না বলে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তিনি নিজের পথে হাঁটতে শুরু করলেন। মনে হলো, এবার বুড়োর মেজাজ বেশ ভালোমতোই বিগড়েছে।
ফার্নান্দো সোরেনতিনো
অনুবাদ: আবুল বাসার
ফার্নান্দো সোরেনতিনো: ১৯৪২ সালের ৬ নভেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস জন্মগ্রহণ করেন সোরেনটিনো। আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় ছোটগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক তিনি। তাঁর অধিকাংশ লেখা বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে লা রিগ্রেসন জুলোজিকা, এন ডিফেন্সা প্রোপিয়া, পার কোল্পা ডেল ডটোর মুর এড আল্টি রাকোন্টি ফ্যান্টাসি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৯, ২০১০
Leave a Reply