‘মিউজিক ভিডিও’ কথাটা শুনলেই মনে হয় গানের একটা জীবন্ত ছবি। ঢাকাসহ সারা দেশেই এখন সবচেয়ে বেশি তৈরি হচ্ছে মিউজিক ভিডিও! কিন্তু এই মিউজিক ভিডিওর সঙ্গে সংগীতের কোনো সম্পর্ক নেই। নাটকের কারণে আমি নানা জায়গায় শুটিং করতে যাই। সবখানেই মিউজিক ভিডিওওয়ালাদের উপস্থিতি। কিছু তরুণ-তরুণী ক্যামেরার সামনে দাপাদাপি করে, নাচানাচি করে, কুশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে। এগুলোই নাকি মিউজিক ভিডিও। এসব মিউজিক ভিডিওর আবার দুই রকম ক্যাটাগরি আছে—ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল!
আমি প্রায়ই চিন্তা করি, খোঁজখবর করি এই মিউজিক ভিডিওগুলো কেন করা হয়, এর উদ্দেশ্য কী, কার্যকারিতাই বা কী?
এর অনেক রকম উত্তর শুনি। তবে সব বিশ্বাস করা কঠিন। আবার ভদ্রসমাজে অনেক কথা বলাও যাবে না। বরং মিউজিক ভিডিও-সংক্রান্ত একটি অভিজ্ঞতার গল্প বলি।
ভদ্রলোক আমার পরিচিত। নাম মিনহাজউদ্দিন। বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্ত্রী নেই। রাতে তাঁর নিদ্রায় সমস্যা হয়। প্রায় রাতেই তিনি ঘুম থেকে চিৎকার করে ওঠেন। ভয় পান। ঘুমের মধ্যে তাঁকে একাধিক বেড়াল আক্রমণ করে। ডাক্তার দেখালেন। দোয়া-তাবিজ আনলেন। ফলাফল শূন্য। বেড়ালের আক্রমণ বন্ধ হয় না। ঘটনা শুনে তাঁর এক আত্মীয় এলেন। সম্পর্কে সাবেক শ্যালক। তিনি রোগ ধরে ফেললেন। বললেন, ‘ঘুমের মধ্যে যে বিলাইগুলো (বেড়ালগুলো) আপনারে অ্যাটাক দেয় (আক্রমণ করে), সেগুলা সব বেডি বিলাই।’ মানে মহিলা বেড়াল! স্ত্রীবিহীন থাকাতে মহিলা বেড়ালের রূপ ধরে ‘খারাপ জিনিস’ তাকে ডিস্টার্ব করছে! বিয়ে করলে সেরে যাবে।
মিনহাজউদ্দিনের সমাধান পছন্দ হলো। কিন্তু এই বয়সে উপযুক্ত পাত্রী পাবেন কোথায়?
শ্যালক বলল, ‘পাত্রী সঙ্গে নিয়ে এসেছি।’ বলেই সে একটা মিউজিক ভিডিওর সিডি বের করল, ‘সিডিটা দেখেন। এইখানে অডিও-ভিডিওসহ সব অ্যাঙ্গেলের শট আছে! এক ঝলকে পাত্রী সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবেন।’
বছর কয় আগেও বিয়েশাদির মতো বিষয়ে বায়োডাটা দিয়ে কাজ শুরু হতো। তারপর স্টিল ছবি দেখাদেখি। সেই দিন শেষ। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। ঘটনা শুরুই হয় মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে।
পাত্রী রূপবতী! অবিবাহিতা অর্থাৎ কুমারী। চাকরানি ফিগার! অতি আকর্ষণীয়। ‘চাকরানি ফিগার’ শুনে অনেকেই ঘাবড়াতে পারেন। তাঁদের জন্য তথ্য হলো, তিন ধরনের ফিগারের মধ্যে চাকরানি ফিগার পুরুষের প্রথম পছন্দ। চাকরানি ফিগারের উল্লেখযোগ্য নারী ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন ভারতের বিখ্যাত নায়িকা শিল্পা শেঠি। উনি চাকরানি ফিগারের অধিকারী। শিল্পা শেঠির মতো চৌকস ফিগার বানানোর সবচেয়ে সহজতম উপায় হলো প্রতিদিন আধাঘণ্টা করে কাপড় কাচা এবং নিয়মিতভাবে ঘর মোছার কাজ করা! আমাদের দেশে ঘরের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ দুটি যেহেতু চাকরেরা করে, তাই এই ফিগারকে বলা হয় চাকরানি ফিগার। পৃথিবীর বেশ কিছু নায়িকা-মডেল এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা নিজেকে আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারী রাখার জন্য নিজেরাই কাপড় কাচার কাজ করেন, ঘর ঝাড়ু দেন এবং ঘর মোছেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত আমার অন্য একটি লেখায় বলব।
মিনহাজউদ্দিন মিউজিক ভিডিওর সিডি দেখে পাগল হয়ে গেলেন। এই কন্যাকেই তিনি বিয়ে করবেন। তাঁর অনুভূতিতে কন্যা রূপের রানি, চোরের রাজা। ভিডিওতেই তাঁর মন চুরি করে ফেলেছে।
এবার আত্মীয় বললেন, আপনে জানেন কি না জানি না, কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে হলে বর্তমানে চারটা সার্টিফিকেট লাগে। এক. বডি ফিটনেস সার্টিফিকেট, দুই. এইডস ফ্রি সার্টিফিকেট, তিন. মাদকমুক্ত সার্টিফিকেট, অর্থাৎ পাত্র ফেনসিডিল বা গাঁজা ইত্যাদি নেশামুক্ত কি না এবং চার. দাঁতের সার্টিফিকেট…!
মিনহাজউদ্দিনের চুল সাদা হতে শুরু করেছে। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। বাংলাদেশে যে এত দ্রুত সব বদল হয়ে যাচ্ছে, টের পাননি। শ্যালক জানালেন, চারটা সার্টিফিকেটই তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। সে জন্য আট হাজার টাকা লাগবে। টাকা দিয়ে হায়াত ছাড়া এই দেশে সব পাওয়া যায়।
যেই, কথা সেই কাজ। সব আয়োজন হলো। এর মধ্যে পাত্রীর সঙ্গে তিনবার টেলিফোনে কথাও বললেন।
পাত্রী যে নৃত্যকলায় পারদর্শী, সেটা মিউজিক ভিডিওতে দেখেছেন। এবার জানলেন, পাত্রী অরিজিনাল সুরে ১১০টি গানও মুখস্থ গাইতে পারেন! মিনহাজউদ্দিনের আনন্দের সীমা নেই! সোনাদানা-নজরানা দিয়ে তিনি এই পাত্রী বিয়ে করবেন। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।
শ্যালক জানালেন, ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক বিয়ের আসরেই পাত্রীর দেনমোহরের টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দিতে হবে।
এই দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই জায়গাটিতে বউকে বঞ্চিত করা হয়। অথচ এটা তাঁর প্রাপ্য। মোহরানার অঙ্ক পরিশোধ ছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করা অন্যায়। নিষিদ্ধ। পাপ।
পারিবারিকভাবে ছোট্ট আয়োজনে বিয়ের আসর বসল। কাজি আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। পাত্রীর সম্মতি চাইলেন, আপনি কি এই বিয়েতে রাজি?
পাত্রী নীরব।
উপস্থিত একজন বললেন, পাত্রীর নীরবতা মানেই সম্মতি। অর্থাৎ রাজি!
কাজি বললেন, না! পাত্রীকে মুখে সম্মতি জানাতে হবে। কারণ পাত্রীর যদি ইতিপূর্বে বিয়ে না হয়ে থাকে, পাত্রী কুমারী হয়, তবেই ওই পাত্রীর নীরবতা মানে সম্মতি বোঝায়। এটা কিতাবের কথা।
মিনহাজউদ্দিন এই প্রথম ধাক্কা খেলেন। পাত্রী কি তাহলে কুমারী না? শ্যালকের দিকে কঠিন চোখে তাকালেন।
শ্যালক অবস্থা বুঝে জানালেন, আপনার সার্টিফিকেট চাইরটাই কিন্তু ভুয়া! মাঢ়ির দাঁতসহ আপনার নয়টা দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত। ডিফেক্ট। এফডিসি থেকে বারো শ টাকা দিয়ে দুই শিফটের জন্য মেকআপম্যান এনে মেকআপ দিয়ে চুল কালি করা হয়েছে। এখন উচ্চবাচ্য করলে মহা বিপদ হতে পারে।
মিনহাজউদ্দিন উচ্চবাচ্য করলেন না। বিয়ে হয়ে গেল। একটা কম বয়সী সুন্দরী বউ পাশে থাকবে—এই বয়সে এটাই বা কম কী!
কিন্তু অনুষ্ঠান করে বউ ঘরে তুলে নেওয়ার আগেই মিনহাজউদ্দিন স্ত্রীর কাছ থেকে তালাকনামা পেলেন। স্বাস্থ্যগতভাবে তিনি আনফিট। স্বামীর সঙ্গে ঘর করবেন না নতুন স্ত্রী। এর মধ্যে সব লেনদেন সম্পন্ন হয়ে গেছে।
মহা ফাঁসে পড়ে গেলেন মিনহাজউদ্দিন। পরে ঘটনা জানা গেল। এই মেয়েটিকে বছরে দুই থেকে তিনবার বিয়ে দেওয়া হয়। এটি তাঁর পঞ্চম বিয়ে। বিয়েতে মোহরানা বাবদ অর্জিত অর্থ ভাগ করে নেয় চক্রের সবাই। তারপর আবার তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় নতুন কোনো মিউজিক ভিডিও!
আবু সুফিয়ান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৯, ২০১০
Leave a Reply