আবুল হোসেনের বয়স এখন নবতিপ্রায়, তাঁর কবিজীবন সাত দশকের কালপরিসরে পরিব্যাপ্ত। সুদীর্ঘ সময়ের সরণিজুড়ে পরিপূর্ণতার পথে তাঁর কাব্যপরিক্রমণে বিরতি আছে, কিন্তু যতি নেই; থেমেছেন তিনি কখনো, কিন্তু থেমে থাকেননি; সাময়িক নীরব থেকেছেন, কিন্তু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েননি। নিজেকে নিরলস নিমগ্ন রেখেছেন তিনি সাহিত্য সাধনায়; থেকেছেন সচেতনতার সঙ্গে সক্রিয়; ক্লান্তিহীন লিখেছেন কবিতা, ‘সমালোচনা, স্মৃতিকথা, ছোটগল্প ও ভ্রমণ-বৃত্তান্ত’, ‘অনুবাদ করেছেন গদ্য ও পদ্য’ অবিশ্রান্ত।
১৯৪৭-এর পরে, দেশ বিভাগের কারণে, কলকাতার কবিতার আসর ছেড়ে ঢাকার সাহিত্যবাসর যে কজন অঙ্গুলিমেয় কবি-সাহিত্যিক সমুজ্জ্বল করে তোলেন, আবুল হোসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। কলকাতায় তাঁর উন্মেষ ও প্রকাশ, ঢাকায় তাঁর বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা। আজকে যাঁরা বয়স্ক, প্রবীণ পাঠক, তাঁরাও তাঁদের বাল্যে ও যৌবনে আস্বাদ গ্রহণ করেছেন এই কবির কাব্যফসলের, আঘ্রাণ নিয়েছেন তাঁর কবিতাকুসুমের। ভাবসম্পদের গভীরতায়, ছন্দ ও প্রকরণের বৈচিত্র্যময়তায়, কাব্যিক আবেদনের আবিষ্টতায় ৭০ বছর ধরে তিনি প্রেমে আর ঘামে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব কাব্যভুবন। সৃষ্টিশীলতার জগতে ক্রমাগত পরিভ্রমণে ও স্বাতিক্রমণে, ‘শব্দচয়ন, ধ্বনিগুণের ব্যবহার ও ছন্দনিরীক্ষায় সার্থকতা এবং আঙ্গিক ও শব্দ ব্যবহারে তাঁর পরিপক্বতা’য় নিজেকে তিনি উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছেন এমন এক উচ্চতায় এবং সমাসীন করতে সফল হয়েছেন এমন এক সিংহাসনে যে তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কবিতার মানচিত্র অঙ্কন এক কথায় অসম্ভব।
প্রতিষ্ঠিত এই কবি পরিণত জীবনের নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সলগ্নে এসে লিখেছেন কবিতা—যাবার আগে। নামকরণের মধ্যেই কবিতার মূল সুর অন্তর্লীন হয়ে আছে। আর এই কবিতার নামেই নামাঙ্কিত হয়েছে কবির সাম্প্রতিক এবং এখন পর্যন্ত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ যাবার আগে। নাম কবিতায় এবং গ্রন্থভুক্ত আরও চারটি কবিতায় (‘যৌথ সঞ্চয়’, ‘সেই শোক’, ‘একাকার হয়ে যায় পৃথিবীর রং’, ‘যে যায় সেই শুধু যায়’) কবির মৃত্যুচিন্তা নানা মাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে। জীবনমুখী কবি তিনি আজীবন, বিষাদঘন বিমূর্ত মৃত্যুভাবনায়ও তাই মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর জীবনবাদী সংবেদ—
‘আমি যেমন এসেছিলাম, সঙ্গী ছাড়াই
ফিরব খালি হাতেই।
জমার খাতে কিছু যদি জমেই থাকে
থাক পড়ে তা এইখানে,
যদি কারও কোনো সময় কাজে লাগে।’
(‘যাবার আগে’)
এই কাব্যগ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে কবির ১৯টি মৌলিক কবিতা। কবিতাগুলো বিভিন্ন সময়ে লেখা—২০০৭ সালে পাঁচটি, ১৯৮০ সালে একটি, ১৯৪২ সালে একটি, ১৯৪০ সালে একটি। অবশিষ্ট ১১টির রচনাকালের উল্লেখ গ্রন্থে অনুপস্থিত। তবে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর পুরো কবিজীবনেই এগুলো সৃজিত হয়েছে। এদিক থেকে কবি আবুল হোসেনের সম্পূর্ণ কাব্যজীবনের একটি পরিচিতিমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল স্মারক হিসেবে গ্রন্থটি মূল্যবান।
নানা সময়ে যেমন রচিত, তেমনই নানা ভাবনার প্রকাশেও কাব্যগ্রন্থটি বিচিত্র। প্রেমভাবনা, বাত্সল্য, সমাজমনস্কতা, কাব্যচিন্তা, স্মৃতিবিধুরতা, মৃত্যুচেতনা, মানবমুখীনতা—মোটকথা কবির সমগ্র জীবনবোধ এই ১৯টি কবিতায় সবিশেষ বাঙময়। এখানে একটি প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে যে সমাজসম্পৃক্তি, স্বদেশভাবনা, স্বকালচেতনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকার প্রথমাবধি কবি আবুল হোসেনের কবিতার অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য। বলা বাহুল্য, এই গ্রন্থও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রন্থে সংকলিত ‘এসো বৃষ্টি, এসো’, ‘কোনো কাব্যরসিক বন্ধুর প্রতি’, ‘১৯৪২’, ‘মানুষের শব’ প্রভৃতি কবিতা সেই দুর্মর সাক্ষ্যই বহন ও প্রদান করে—‘কথায় ভেজে না চিঁড়ে—ধনমান-প্রেম নয়, নয়,/চেয়েছি তো ডালভাত আর একটু আশ্রয়।/সোনায় বাঁকানো ঘাড় সোজা যদি না হয় না হোক,/মই পড়ে পড়ে যার পাকা ধানে তার লাঙ্গলে কাস্তেতে/ধার দিতে ক্ষয়ে যদি যায় যাক কলমের শাণ,/আমরা না হয় বাঁধি বাসা, আগামীরা গাবে গান।’ (‘কোনো কাব্যরসিক বন্ধুর প্রতি’)
সর্বকালীন কবিতার, তথা শিল্পের, তথা জীবনের আরেক অনুপেক্ষণীয় মৌল অনুভব প্রেম, সেই তুমুল প্রেমও শিল্পরূপ পরিগ্রহ করেছে কবির কলমে;—জীবনের পঁচাশি বর্ষা আর পঁচাশি বসন্ত অতিক্রম করেও তিনি সমান সংরক্ত থাকতে পারেন প্রেম ভাবনায়, প্রেমের কবিতায়। তাই ২০০৭-এ এসে তিনি লিখতে পারেন—‘হাজার বছর ধরে কত কী যে বলেছে কবিরা—/বুকের আগুন থেকে হূদয়ে জোয়ার/আর স্বপ্নে, গানে একাকার হয়ে যাওয়া/জীবন ও পৃথিবীর রং।’ (‘মেহেদীর জন্য’)
কেবল মৌলিক কবিতা নয়, এই কাব্যগ্রন্থে ঠাঁই নিয়েছে কবির অনূদিত পাঁচজন কবির তেরটি কবিতা—‘সন্ধে নেমে এল’ উপশিরোনামভুক্ত হয়ে—রবার্ট ফ্রস্টের তিনটি, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার একটি, হুয়ান রামন হিমেনেথের একটি, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের সাতটি এবং হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের একটি। সবাই যেমন কবি নন, তেমনই গদ্যে বা পদ্যে রচিত বয়ানমাত্রই কাব্য নয়—এক অনির্বচনীয় রহস্যে ও মন্ময় ম্যাজিকে তা হয়ে ওঠে কবিতা। কবি এক ঐন্দ্রজালিক, জাদুমন্ত্রবলে তিনি বিস্তার করেন আনুভূতিক ইন্দ্রজাল। ভাব আর ভাষার ঐকতানিক মূর্ছনায় উত্সারিত হয় যখন ব্যঞ্জনা—শব্দার্থের চিরচেনা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, পরিচিত পরিসীমা পেরিয়ে দূরপারের দুর্জ্ঞেয় চুপকথার বহুমাত্রিক ও অনেকান্ত অভিব্যঞ্জনায় কবিতা ছড়ায় তখন হীরকদ্যুতি। সৃষ্টিক্ষম কবির অলৌকিক আনন্দ তাই তাঁর মৌলিক কবিতায় যেমন বহুবর্ণে প্রতিফলিত হয়, তেমনই তা দ্যোতনাময় হয়ে ওঠে অনুবাদ কর্মেও। কবি আবুল হোসেনের অনুবাদেও পাওয়া যায় তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ—‘উপলব্ধির আলো আমাকে বিচক্ষণ করেছে।/বালি এবং চুমোয় ভরে/আমি তাকে নদীর তীর থেকে নিয়ে এলাম।/পদ্মফুলের ডগা এখনো বাতাসে উড়ছে।’ (‘অবিশ্বাসিনী স্ত্রী’—ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা)
বস্তুত, কবি আবুল হোসেনের একগুচ্ছ মৌলিক ও অনূদিত কবিতার সার্থক যুগলবন্দী যাবার আগে। তবে যাওয়ার আগে আরও বহুকাল ধরে বাংলা কবিতার পাঠকদের তিনি আরও আরও কবিতা উপহার দিয়ে সমৃদ্ধতর করে যাবেন বাংলা কবিতার ঈর্ষণীয় বিচিত্র বিপুল ভাণ্ডার—এমন আশান্বিত উপসংহারে উপনীত হয়েই একমাত্র এই সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ যশস্বী কবির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা সম্ভব।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply