রিংটোন বাজতেই লাফ দিয়ে উঠলাম। নিতুর ফোন। গলার স্বর যতটা সম্ভব নরম করে বললাম, জান, কেমন আছো?
—সারা দিন কোনো খোঁজ নেই, এখন বলো কেমন আছো! শোনো, পয়লা বৈশাখে তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে ঘুরবে।
—অবশ্যই। একেবারে শেন ওয়ার্নের বলের মতো ঘুরব।
—খবরদার, শার্ট-প্যান্ট পরে আসবে না।
—আরে বলে কি! শার্ট-প্যান্ট ছাড়া আসব কীভাবে? শরমের ব্যাপার।
—ধ্যাত! বিশ্বে এত কিছু হচ্ছে, অথচ তোমার মাথায় বুদ্ধি হচ্ছে না, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরবে। আমিও শাড়ি পরব। এই দিনে ট্র্যাডিশনাল ড্রেস না পরলে স্ট্যাটাস থাকবে না।
—ঠিক, সূর্যি মামা জাগার আগেই উঠব আমি জেগে। উঠে তোমার বাসার সামনে গিয়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকব।
—মনে থাকবে তো?
‘কী যে বলো, জান’…বলতেই ঘরে মা ঢুকে পড়ল। সর্বনাশ! আমি যে ‘জান’ ‘জান’ বলেছি, মা কি শুনে ফেলল? আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ভাইজান, একটু সামনে যান, আরে যান না, যান…
নিতু অবাক হয়ে বলল, কী বলছ এসব? কোথায় যাব? ভাইজানটা কে?
পেছনে মা দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, ভাইজান, রাখি। স্লামালেকুম।’
মা বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
—এক বড় ভাইজানের সঙ্গে। কিছু বলবে?
—পয়লা বৈশাখে আমি আর তোর বাবা ভোরবেলা বেরিয়ে যাব, রাতুলের পরীক্ষা। তুই বাসায় থাকবি। নইলে ও পড়ায় ফাঁকি দিয়ে গেমটেম খেলবে।
—অসম্ভব। আমার অন্য প্ল্যান আছে। আমি বাসায় থাকতে পারব না।
—আশ্চর্য! ছোট ভাইয়ের পরীক্ষা, তোর একটা দায়িত্ব আছে না! এইচএসসি কোনো যেনতেন পরীক্ষা না, ভয়ংকর পরীক্ষা।
—তাতে আমার কী? ওর পড়া ও পড়বে। একজনের ডায়রিয়া হলে সবাইকে স্যালাইন খেতে হবে, এটা কেমন কথা?
—ডায়রিয়ার কথা এল কেন! বেয়াদব। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। আর এই দিনে তুই তো কখনোই বাইরে যাস না, হঠাৎ কী?
—ঘুঘু বারবার ধান খায় না, বারবার খায় চড়ুই পাখি। আমি চড়ুই পাখি না। আগে যাইনি তো কী হয়েছে? এবার যাব। বন্ধুদের সঙ্গে রমনার বটমূলে গিয়ে গান শুনব। এসো হে বৈশাখ…এসো এসো…!
—ওখানে গিয়ে গান শুনবি? সারা বছর ‘ইয়ো ইয়ো’ টাইপ গান শুনে কান পচিয়ে ফেলে এখন বলছিস রমনায় গান শুনতে যাবি! বল তো, এ গানটা কে লিখেছে?
—কে আবার? একজন গীতিকার লিখেছে।
—সেই গীতিকারের নামটা কী?
—আরে আজব! আমি নাম-ঠিকানা মুখস্থ করে রেখেছি নাকি? বাবার নামটাই তো মাঝে মাঝে ভুলে যাই।
—মুরগির ছোট মাথায় যত বুদ্ধি আছে, তোর এত বড় মাথায়ও তা নেই। যা, তোকে বাসায় থাকতে হবে না। আমরাই বাসায় থাকব। তুই থাকলে তোর ভাইটাও তোর মতো বেকুব হবে।
আহ্! বাঁচলাম। কী সুন্দরভাবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে একটা জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদেরা আলোচনাই করতে চায় না। এই জন্যই দেশটা পিছিয়ে যাচ্ছে।
পয়লা বৈশাখে ভোরবেলা নিতুর বাসার সামনে চলে এলাম। নিতু একেবারে রেডি হয়ে ছিল, ফোন দিতেই বেরিয়ে এল। মোবাইল ফোনটা অফ করে দিলাম আমি। এবার নিশ্চিন্তে বেড়ানো যাবে। নিতু বিরক্ত হয়ে বলল,
—সেকি! এটা কী কালারের পাঞ্জাবি পরেছ? ক্যাট ক্যাট করছে। আর সঙ্গে জিনস পরলে কেন? পায়জামা কোথায়?
—বাসায়। পায়জামার ফিতা খুঁজে পাইনি, তাই জিনস পরলাম। চলো, যাওয়া যাক।
রমনায় গিয়ে দেখি ব্যাপক ভিড়। সবাই বসে গান শুনছে। নিতুও মাথা দুলিয়ে গান শুনতে লাগল। যে মেয়ে হিন্দি গান ছাড়া অন্য কোনো গান শোনে না, সে রবীন্দ্রসংগীত শুনছে দেখে দারুণ অবাক হলাম। আমার হাতে ক্যামেরা দিয়ে ও বলল, ‘আমি ঐতিহ্যবাহী গান শুনছি, এটার ছবি তোলো। ফেসবুকে আপলোড করব।’ আমি বিভিন্ন কায়দায় ছবি তুললাম। এবার সে ঠিক করল, পান্তা-ইলিশ খাবে। ‘এখানকার খাওয়া অস্বাস্থ্যকর, পান্তা-ইলিশ আমাদের ঐতিহ্য না’—এসব বলেও তাকে দমিয়ে রাখা গেল না। সে একটা দোকানে ঢুকে কপ কপ করে পান্তা খেতে লাগল। আমাকে বলল, তুমি খাবে না? আমি বেশ ভাব নিয়ে বললাম, ‘পান্তা আমি খাই না।’ আমার কাজ ছবি তোলা। আমি সেটাই করতে লাগলাম। নিতুকে বললাম, তুমি তো ফ্রাইড রাইস-ফাস্টফুড ছাড়া অন্য কিছু খাও না, আজকে পান্তা খাচ্ছ যে?
—আজকে ফ্রাইড রাইস খেলে মানুষ কী বলবে? আর রাতে তো ফ্রাইড রাইসই খাব।
বাহ্! একেবারে খাঁটি বাঙালি। পান্তার বিলে অনেকগুলো টাকা চলে গেল। কোনো ব্যাপার না। টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। হঠাৎ শুনি কে যেন রাগত স্বরে আমাকে ডাকছে। ডানে-বাঁয়ে কাউকে দেখলাম না। নিতু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই টাকলা লোকটা তোমাকে ডাকছে।
—সর্বনাশ!
—কী হয়েছে? উনি কি তোমার কাছে টাকা পান?
—আরে রাখো! উনি আমার বাবা, ওনার সাথে যে মহিলাকে দেখছ, উনি আমার মা। এখন কী করব? ঘুরে দৌড় দেব?
—দেখো, আমি দৌড়-টৌড় দিতে পারব না। শাড়ি পরে ঠিকমতো হাঁটতেই পারি না, দৌড়াব কী করে? তা ছাড়া হাইহিল পরেছি তো। নইলে দৌড়ে আমার সঙ্গে পারতে না, কলেজে ১০০ মিটারে আমি প্রথম হয়েছিলাম।
—ওহ্! এত কথা বলছ কেন? অফ যাও!
বাবার সামনে আসতেই বাবা বিকট গলায় ধমক দিয়ে বসলেন, এই তোমার গান শোনা? এই তোমার বন্ধু-বান্ধব? টাংকি মারা শিখে গেছ? আজকে বাসায় আসো, তোমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। লালগালিচা সংবর্ধনা।
বাবা-মা হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। কিন্তু ওরা এখানে, তাহলে বাসায় কে? দূর্। দিনটাই মাটি। নিতুকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় এসে দেখি সোফার ওপর আমার বন্ধু রবিন বসে আছে।
—তুই এখানে ক্যান?
—তোকে ভোর থেকে ফোন দিচ্ছি, ফোন বন্ধ। বাসায় এসে শুনি তুই নেই। আমি একা একা কী করব? আন্টিকে বললাম, ‘আমি বাসায় আছি, আপনারা ঘুরে আসেন।’ ভালো কথা, তুই কোথায় গিয়েছিলি?
আমি ধপ করে বসে পড়লাম। ইশ! কোন দুঃখে যে ফোনটা বন্ধ রেখেছিলাম। ফোন অন থাকলে আর এইভাবে ধরা খেতে হতো না। মাথার মধ্যে বিজ্ঞাপন ঘুরতে লাগল…ও এন অন… ও এন অন!
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১২, ২০১০
Leave a Reply