পয়লা বৈশাখের সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি ঘড়িতে স্ট্যান্ডার্ড টাইম ১০টা ১০ বেজে ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা আমার দিকে হাসির ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ঘড়ির এ রসিকতায় আমি মর্মাহত হই। ঘড়ির ক্ষীণ অ্যালার্ম কখনোই আমার ঘুমকে ভঙ্গুর বস্তুতে পরিণত করতে পারেনি, সেখানে না হয় ঘড়ির ব্যর্থতার চেয়ে আমার ঘুমের সফলতাই বেশি দায়ী, কিন্তু সময়ের এ রসিকতায় আমি রীতিমতো বিরক্ত হই। বছরের প্রথম দিনটিতেই আমাকে দেরি করিয়ে দেওয়ার মতো সময়ের এ হেন অসত্ উদ্দেশ্যকে নাস্তানাবুদ করতে নাশতা না করেই তাই বেরিয়ে পড়ি তড়িঘড়ি করে, ঘরের ঘড়িকে ঘৃণাভরে পরিত্যক্ত রেখে। অবশ্য তার আগে দিনটা যাতে দীনভাবে না শুরু হয় সে জন্য পিতার পকেটে অভিযানপূর্বক নিজ মানিব্যাগের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভুলি না।
রাস্তায় নেমেই কবিবন্ধু রকিবুলকে ফোন লাগাই—
‘কীরে, আমাকে রাইখা নিশ্চয়ই পান্তা-ইলিশ গিলতেছিস?’ আমার তরফ থেকে প্রশ্নসহযোগে আক্ষেপ।
জবাবে ওপাশ থেকে অস্ফুট স্বর শোনা যায়, ‘ধুত, ফাও প্যাঁচাল রাখ, রুমে আয়।’
খানিকটা স্বস্তি পাই, যাক রকিবুলটা এখনো আছে। গিয়ে দেখি কোথায় আমার তাড়াহুড়ো, নাসিকা গর্জন সহযোগে তখনো ও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
সূর্য উদয়ের পরও কীভাবে মানুষ ঘুমিয়ে থাকতে পারে সে বিষয়ে হাঁকডাক সহযোগে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ বাক্যালাপ করি। তাতে আধা ঘণ্টা পর একটা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরে ও রেডি হয়। ওর মতে, পয়লা বৈশাখে লুঙ্গি পরাই বাঙালিপনার পরিচায়ক।
‘তুইও একটা লুঙ্গি পরে নে না!’ ওর বিনীত অনুরোধ আমার প্রতি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমারও দুর্বিনীত নাকচ ঘোষণা।
বাইরে বেরোতেই বলল, ‘চল, বাংলাবাজারে যাই।’
শুনে আমি একেবারে মহাকাশ থেকে পড়ি। অতঃপর এ আকস্মিক পতন সামলে বলি—
‘ক্যান, রমনায় প্রবলেম কী?’
‘দ্যাখ, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানোর অভ্যাস তোর গেল না। ক্যান রমনাতে কী এমন দেখবার-শুনবার আছে?’
‘আর কিছু না-ই থাকল, রমনায় অন্তত রমণীরা তো আছে।’ আমি মিনমিন করি।
ও আমার কথায় কান দেয় না। বাংলাবাজারের উদ্দেশেই রওনা দিতে হয় ওর সঙ্গে। ওখানে কোনো এক বিরাট কবি নাকি বসে আছেন, পয়লা বৈশাখ নিয়ে এক জরুরি আলোচনা সভায় তাঁর সঙ্গে যোগদান করতে হবে।
চুল-দাড়ির বাহারি ঢঙের অনেক কবিরই দর্শনলাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছি ইতিমধ্যে, কিন্তু চুল, দাড়ি, গোঁফবিহীন এমন নির্লোম কোনো কবিকে বোধহয় আগে দেখিনি। নিখুঁতভাবে চাঁছা মাথায় রোদ পড়ে চকচক করছে কবি গুলগেলাস ঠাকুরের। রকিবুল গিয়েই কদমবুসি করে। আমিও অগ্রবর্তী হব কি না ভাবছিলাম, এমন সময় কবি গলা খাকারি দিলেন—
‘ইহাকে নূতন বোধ হইতেছে?’
‘জি গুরু, আমার ইয়ার দোস্ত, লেখালেখি করার বদঅভ্যাস আছে, তবে বড় বেশি নীরস, কবিতা লেখে না।’
শুনে কবি চকচকে মাথায় হাত বুলান, নাকি মাথায় হাত দেন বোঝা যায় না।
‘আসলে ইহার জন্য প্রয়োজন হূদয়ের শুদ্ধি, মননকে ঋদ্ধতা দান। ওর পামর মন এখনো কাব্যের উপযোগী বিচরণভূম হয়ে ওঠেনি, যেখানে কবিতার চরণেরা ঘটকীদের মতো ঘট-ঘট করে দৌড়ে বেড়াবে আর তৃপ্তির চোয়া ঢেঁকুর তুলবে’, কবি বাতলে দিলেন আমার কবিতাহীনতার শানেনজুল।
‘গুরু, তবে কীভাবে ও করবে শুরু?’ রকিবুলের বিগলিত প্রশ্ন।
শুনে আমার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। কোথায় পান্তা-সহযোগে ইলিশ দিয়ে ভূরিভোজন করব তা না আমার কাব্য প্রতিভার অন্বেষণে রীতিমতো ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব।
‘এর জন্য প্রয়োজন কবিতা শোনা ও হূদয়ঙ্গম করা’, কবি সমাধান বাতলান, ‘তবে শুরু হোক—’ কবি গুলগেলাস তাঁর ঝুলব্যাগ থেকে কবিতার বই বের করে পাঠ শুরু করলেন।
তারপর যা শুরু হলো তা কহতব্য নয়, শ্রুতিযোগ্যও কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ বিদ্যমান। সভায় অন্য যারা ছিল (অধিকাংশই নবীন কবি) তারা চোখ বুজে এমনভাবে শুনতে লাগল যেন কবি গুলগেলাস তাদের রসগোল্লা গেলাচ্ছেন। কবি পাঠ করে যাচ্ছেন—
বৈশাখের কাব্যিক ডানায়
হারানো কবিত্ব রুগ্ণ
অকাল এ অবিমৃষ্যতাভেদী
টম অ্যান্ড জেরি শৈশব জলকেলী মগ্ন
কবির হাত থেকে ছাড়া পাই ঘণ্টা তিনেক পর। এরই মধ্যে হাজারখানেক কবিতা শোনার ভারে আমার মাথা ঝিমঝিম করার টারশিয়ারি পর্যায়ে চলে গেছে। রকিবুলকে সুশ্রাব্য কিছু বলার প্রচণ্ড ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্টে দমিয়ে রাখি।
দেরি করে হলেও পান্তা-ইলিশ পাওয়া যায়। সারা দিনের অভুক্ত আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু খেতে গিয়ে মাথায় বেজে ওঠে কবি গুলগেলাসের অমীয় বাণী—
‘তোমাদের ইলিশ সভ্যতা
আর পান্তার প্রাতিস্বিক মালসা,
চেয়ে থাকা কর্বূর চোখে
অলম্বুষের অতলান্তিক লালসা…
তখন দেখি পান্তা আর গলা দিয়ে নামছে না, অভুক্ত অবস্থাতেই বাড়ি ফিরতে হয়।
এর পর থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি, পয়লা বৈশাখ ঘরে বসেই উদ্যাপন করব, অ্যালার্ম আর মুঠোফোন বন্ধ করে উপর্যুপরি নাসিকা গর্জন সহযোগে…অন্তত সূর্য পশ্চিমে মোড় নেওয়ার আগ পর্যন্ত।
মাসুদুল হক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১২, ২০১০
Leave a Reply