পেতিকন খুব অদ্ভুত ধরনের। আমি ওকে অনেক দিন থেকেই চিনি। বিয়ে করেনি। আর আমাদের ১৭এ নম্বর বাড়িতেই থাকে সে। খুব চাপা আর চুপচাপ। কখনো গান গাওয়া বা গিটার বাজানো—এসব কিছুই করে না সে। খুব গম্ভীর আর ভদ্রও। পেতিকন একটা কারখানার পরীক্ষাগারে কাজ করে।
আমি এখন একটা ঘটনার কথা বলব, যাতে পেতিকন আর আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম। আর আমি ভয়ে মরো মরো হয়ে গিয়েছিলাম। এত ভয় পেয়েছিলাম যে সেই থেকে ঠিক করেছিলাম, আর কাউকে কখনো সাঁতার শেখাতে যাব না। আমিও একটু ভীতু ধরনের। কাউকে ডুবে যেতে দেখতে পারি না।
ব্যাপারটা হলো, এ বছর ছুটিতে আমি সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনেই আমি সমুদ্রের তীরে পেটকিনের দেখা পেলাম। বদমাশটা তার গায়ের রং বাদামি করার জন্য শক্ত একটা পাথরের ওপর শুয়ে ছিল। লক্ষ করলাম, সমুদ্রের দিকে যাওয়ার তার কোনো ইচ্ছা নেই।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্নান করতে সমুদ্রে যাবে না?’
‘—না, পরফিরি নিকোলায়েভিচ।’ বলল সে লাল হয়ে। ‘ছোটবেলা থেকেই পানিতে আমার বড় ভয়। সমুদ্র তো দূরের কথা, নদীকেও আমি ভয় করি। পানির ভেতরে কী আছে, কিছু বোঝা যায় না। আর অগাধ পানিতে পড়লে তো কথাই নেই।’
অদ্ভুত এই পেতিকন। তার কথায় আমার হাসি পেল। বয়সে যুবক, অথচ পানিতে এত ভয়! তা ছাড়া নানা রকমের খেলাধুলায় এখানে সবাই মত্ত। মেয়েরাও।
কাজেই পেতিকনকে বললাম, এটা খুব খারাপ। মেয়েরাও তোমাকে দেখে হাসবে। কমরেড পেতিকন, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। তোমার অভ্যাস বদলানো দরকার।
ছোটদের মতো লজ্জা পেয়ে সে বলল, কী করব, এটাই আমার স্বভাব! কথায় আছে, স্বভাব যায় না মলে।
জোর গলায় বললাম, ইচ্ছে করলে সবই হয়। তুমি সাঁতার শেখো। আমি তোমাকে শেখাব। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি।
শুনে সে ভয় পেয়ে বলে উঠল, না, না। তা হয় না। আমি পারব না। আগে শিখলে হতো।
বললাম, ভয় নেই। দায়িত্ব নিচ্ছি আমি। কাল থেকেই শুরু করা যাক।
সে কিছু বলল না। কী আর বলবে? আমি অনেক করেই তার মনে সাহস এনেছিলাম।
পরের দিন আমি পেতিকনকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে এলাম। বেচারা আমার সঙ্গে যেন ফাঁসির মঞ্চে এল। আমরা আগেই সাঁতারের পোশাক পরে নিয়েছিলাম।
‘নাও, এসো পানিতে!’ বেশ জোর গলায় বললাম।
সে চোখ বন্ধ করে পানিতে নামল। আর তখন থেকেই মজা শুরু হলো। কোনোরকমে হাঁটুপানি পর্যন্ত এগিয়েই ভয়ে পালিয়ে আসতে লাগল সে। আমি তাকে তাড়া করলাম। সে অন্যদিকে দৌড়ে চলে গেল। শয়তানটা কেবল ডাঙায় চলে আসতে চায়। এভাবে চলল ঘণ্টাখানেক। আর আমিও তাকে তাড়াতে-তাড়াতে হাঁফিয়ে উঠলাম।
শেষ পর্যন্ত সে সমুদ্রের তীরে এসেই বালিতে শুয়ে পড়ল। বলল, প্লিজ, পরফিরি নিকোলায়েভিচ, আমার দ্বারা সাঁতার শেখা হবে না। মাফ করো।
‘উহু।’ আমি বললাম, ‘কাল আবার হবে। একবার যখন ধরা হয়েছে, ছাড়া যাবে না কিছুতেই। সাঁতার তোমাকে শেখাবই—এ আমার শেষ কথা।’
পেতিকন পরের দিন এল। যেন সে একজন হত্যাকারী আর আমি তাকে দণ্ডাদেশ দেব।
আজ থাক না?
না, না। এসো, পানিতে এসো।
আমি তাকে নিয়ে পানিতে নামলাম। তাকে সাঁতারে হাত-টানার কায়দা দেখাতে লাগলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পেতিকন হাত-টানার কায়দাটা শিখে নিল। তবে পা চালানো ঠিক হলো না। পানির নিচের মাটি থেকে পা তুলতে সাহস পাচ্ছিল না সে। শেষে চেষ্টা করে তার একটা করে পা উঠাতে পারলাম মাটি থেকে। কিন্তু দুটো পা একসঙ্গে কিছুতেই ওঠাতে পারল না সে। আমিও আর পারলাম না ওর সঙ্গে। সেদিনকার মতো বাদ দিলাম।
পরের দিন পেতিকনকে নিয়ে এসে দেখি, সমুদ্রে খুব ঢেউ। পেতিকনকে বললাম, আজ আর হবে না দেখছি। খুব ঢেউ। যাক, বেঁচে গেলে আজ।
কিন্তু পেতিকন বেশ অদ্ভুত রকমের, আগেই বলেছি। সে সাঁতারের পোশাক পরে নিয়ে বলল, তোমার চেষ্টায় এতটা শিখে আমি যদি প্র্যাকটিস না করি, আবার তাহলে ভুলে যাব। পানির ধারেই একটু হাত-পা ছুড়ি, কী বলো?
বলেই শয়তানটা কী করল জানো? সোজা পানিতে গিয়ে ঝাঁপ দিল। দেখেই আমি ছুটে গেলাম, আরে, কী করছ? বড় বড় ঢেউ আসছে। তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যে!
সর্বনাশ! দেখি প্রচণ্ড ঝড় উঠল। পেতিকনকেও আর দেখা যাচ্ছে না। আমি প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগলাম, কমরেড পেতিকন, কমরেড পেতিকন!
১০ গজ দূরে সমুদ্রের পানিতে হঠাৎ দেখি, কী যেন ঢেউয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার পোশাক-আশাক ছেড়ে পানিতে লাফিয়ে পড়লাম। ঢেউ আমার ওপর দিয়ে গিয়ে আমাকে ঠেলে পেছিয়ে নিয়ে এল। আমি তীরে এসেই লাফিয়ে উঠে চেঁচাতে আরম্ভ করলাম, ওগো, তোমরা কে কোথায় আছ, শিগগির এসো, একটা লোক ডুবে যাচ্ছে!
শুনে লোকজন ছুটে এল। তাদের মধ্যে যাদের সাহস আছে, তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানির পুলিশেরাও ছুটে এল তাড়াতাড়ি। আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো নিজের মনে কী যেন বকতে লাগলাম।
হঠাৎ দেখি, প্রায় ৫০ গজ দূরে একটা লোক উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতার কাটছে। আর কী চমৎকার সাঁতার কাটছে। ভয়ংকর ঢেউগুলো তার কাছে যেন কিছুই না। সমুদ্রের তীরে দাঁড়ানো একজন নাবিক তার বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে ভালো করে দেখে বলল, না, না, ভাবনার কিছু নেই। ওই লোকটা তো দেখছি বিখ্যাত সাঁতারু পেতিকন। বহু পুরস্কার বিজয়ী। নাম শোনোনি ওর, পেতিকনের?
পেতিকন! এবার সবাই আমার দিকে চেয়ে হাসতে লাগল। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হলো, হে ধরণী দ্বিধা হও!
ওই পেতিকন, শয়তান, কদিন ধরে আমাকে নিয়ে মজা করল। সেই থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনো কাউকে সাঁতার শেখাতে
যাব না।
জি রিকলিন: রুশ লেখক।
অনুবাদ: কুমারেশ ঘোষ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৫, ২০১০
Leave a Reply