নতুন কিছু একটা করতে হবে। এ কথাটা মাঝেমধ্যেই কানের পর্দায় এসে বাড়ি মেরে যায়। পুরোনো যা কিছু, সব বদলে ফেলে নতুন করে গড়তে হবে। এই বাক্য এখন বাজারের পচা কুমড়োর মতো এখানে-সেখানে পড়ে থাকে। তার পরও এসব কথা কেউ কেউ বলেই খালাস, আবার কেউ কেউ করে দেখায়। তো সেই করে দেখানোর নমুনা কেমন, তার একটা ঘটনা বলি।
কী এক সেবাপ্রতিষ্ঠানের দুই কর্মীকে তাদের বস হুকুম দিয়েছেন, সামনে ‘শিশু অধিকার’ দিবস, কিছু একটা করতে হবে। শুধু করলেই হবে না, সবাই যেন চমকে যায়, এমন কিছু। দুজনের মাথা ঘুরছে, কী করা যায় তা ভেবে ভেবে। মানুষকে চমকাবে কি, নিজেরাই ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছে। বস আসার আগে ভেবে কিছু বের করতে না পারলে খবর আছে। দুম করে টেবিলে একটা কিল বসিয়ে একজন বলে, ‘ভাই, একটা কিছু বলেন, তা না হলে বস দুজনেরই চাকরি খেয়ে ফেলবে।’
অপরজন ভ্রূ দুটো কুঁচকে বলেন, ‘আমি কেন, আপনিই বলেন।’
‘কী জানি, আমার মাথায় কিছু আসছে না!’
‘আচ্ছা, একটা শোভাযাত্রা করলে কেমন হয়, ছোটদের নিয়ে?’
‘ঠিক বলেছেন, শোভাযাত্রা হলেই তার সঙ্গে নানা রকম প্রোগ্রাম জুড়ে দেওয়া যাবে।’
‘আর ধরেন, বিষয়টা হবে পরিবেশ।’
‘আরে, এটা তো পরিবেশ দিবস না, শিশু অধিকার দিবস।’
‘তাতে কি! শিশুদের নানা রকম অধিকারের মধ্যে সুস্থ পরিবেশ থাকতে পারে না?’
‘তা তো পারে, কিন্তু কীভাবে কী করা যায়, বলেন তো?’
‘কেন, আমরা এখন নানা রকম দূষণের মধ্যে বাস করছি। সেটা থেকে মুক্তি চাইতে পারি। কী বলেন!’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।’
‘অতএব “দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই” স্লোগানে আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে ফেলতে হবে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো হবে। আর সেই সঙ্গে, ধরেন, আমাদের মহিলা কর্মীরা থাকবেন। তাঁদের পরনে থাকবে সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি।’
পুরো প্লানটা ছকে ফেলতে ফেলতে বস চলে এলেন। একজন তখন শোভাযাত্রার সঙ্গে আর কী কী করা যায় তার একটা তালিকা বানাচ্ছিল। অন্যজন সেই ফাঁকে বসের ঘরে গিয়ে ঢোকে, স্যার, শিশুদের একটা শোভাযাত্রার আইডিয়া ঠিক করেছি। স্লোগান হবে, ‘দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই’।
বস মুগ্ধ চোখে তাকান, ‘ওহ! তারিক, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা যে কীভাবে করব, বুঝতে পারছি না।’
‘না, না, স্যার, এ আর এমন কী। কী কী লাগবে তার একটা তালিকা বানাতে লাগিয়ে দিয়েছি মহসিনকে।’
‘গুড, ভেরি গুড। ওটা হয়ে গেলেই একটা প্রজেক্ট প্রোফাইল করে ফেলতে হবে।’
‘সেটাও করে ফেলব, স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না।’
‘হ্যাঁ, দেখো খুব অ্যাট্রাকটিভ যেন হয়। ডোনারদের ফাঁসাতে হলে জাঁকজমক দরকার।’
তালিকা হয়ে গেলে বস এসে ঢোকেন তাদের ঘরে। তারিকের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাহলে তারিক, প্রজেক্ট প্রোফাইলটা করে ফেলো। ততক্ষণে আমি কয়েকটা খোঁজখবর লাগাই, যেন ভালো কিছু ডোনার ধরা যায়।’
তারিক উত্তর দেয়, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, স্যার, সব হয়ে যাবে।’ ‘দেখবে ভুলটুল হয় না যেন।’ তার পরই বেরিয়ে গেলেন তিনি। তারিক মহসিনকে বলে, ‘তাহলে প্রজেক্ট প্রোফাইলটা তৈরি করে ফেলেন।’
মহসিন কিছুটা শুকনো গলায় বলে, ‘আপনাকে করতে বললেন যখন, তখন আপনিই করেন।’
তারিক অবাক হওয়ার সুরে বলে, ‘কী যে বলেন না আপনি, আমাকে একা বলেছে নাকি! স্যার তো জানেন আপনিই সব করবেন। ভদ্রতা করে আমাকে বলে গেলেন।’
পরদিন প্রোজেক্ট প্রোফাইলের ফাইলটা হাতে নিয়ে মহসিন দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থাকে বসের ঘর থেকে খানিকটা দূরে। তারিক বলেন, ‘কী, ভয় পাচ্ছেন? আমাকে দিন, যদি টুকটাক ভুল থাকে, তা আমি সামলে নেব।’
এরপর তারিক বসের প্রশংসায় সিক্ত হয়ে বের হয়ে আসেন। তিনি নিশ্চিত এবার তাঁর ফ্ল্যাট বুকিংয়ের টাকাটা বোনাস হিসেবে পেয়ে যাবেন। মহসিনকে এসে অবশ্য বলেন, ‘বসরা যা হয়, বোঝেন তো। শুধু বললেন, ভালো হয়েছে, আর কিছু না।’
কয়েক দিন পর সকাল আটটায় দেখা গেল বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়েছে। শ দেড়েক বাচ্চা ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশা-ভ্যানে করে স্লোগানে স্ল্লোগানে এগিয়ে চলেছে। সঙ্গে আছেন তারিক তাঁর দলবল নিয়ে। হলুদ শার্ট পরে বাচ্চাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। গতকাল বস তাঁর নতুন কেনা গাড়িতে করে লিফ্ট দিয়েছেন। যেতে যেতে বলেছেন, বিদেশি মেহমানরা আসবে তো, তাই পুরোনো গাড়িটা পাল্টে ফেলতে হলো। তারিকও আভাসে-ইঙ্গিতে ফ্ল্যাট বুকিংয়ের কথাটা জানিয়েছে। মনে হয়, হয়ে যাবে। আজকের কাজটা সেই জন্য একেবারে নিখুঁতভাবে করতে হবে। একটা বাচ্চা ভ্যানের ওপর ঘুমিয়ে পড়ছিল। তাকে এক ধমক দিয়ে জাগিয়ে তুলল। চারদিকে অফিসযাত্রীর ভিড়, একেবারে জ্যাম লেগে গেছে। তাদের শোভাযাত্রার জন্য গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে। বিশাল লাইন হয়েছে গাড়ি, রিকশা আর বাসের। ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেছে, নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা বাচ্চাদের বলে, ‘সবাই জোরে বলো, দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই।’
বাচ্চারা কাশতে কাশতে বলে, ‘দূষণমুক্ত খক্ খক্ পরিবেশ খক্ খক্-চাই, খক্ খক্ খক্…।’
সাজ্জাদ কবীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৫, ২০১০
Leave a Reply