আমরা অর্থাৎ মানুষেরা পুরো ছাত্রজীবন ধরেই গরু নিয়ে রচনা লিখেছি। যেহেতু এখন দিন বদলেছে, অতএব এই দিনবদলের হাওয়া গরুর গায়ে লাগতেই পারে। তাই গরুও উল্টো রচনা লিখতে পারে মানুষকে নিয়ে। লিখতে পারে মানে? আরে লিখেই তো ফেলেছে। নানা গরুর খাতা থেকে সেই সব রচনা সংগ্রহ করে তুলে ধরেছেন ইকবাল খন্দকার
বকনা বাছুরের লেখা রচনা
মানুষ একটা স্বার্থপর প্রজাতির জীব। কারণ সে সব সময় তক্কে তক্কে থাকে, কখন আমার মায়ের দুধ দুইয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে। নিজেরা তো দুধ খায়ই, বাকিটা বিক্রি করে দেয় মোড়ের চায়ের দোকানদারের কাছে। মানুষের কান, নাক, গলা—সবই আছে। শুধু গলায় আমার মতো দড়ি থাকে না। তবে কেউ কেউ যে গলায় দড়ি পরে না, তা কিন্তু নয়। এই দড়িকে অবশ্য চেইন বা মালা বলা হয়। তবে এই দড়ি দিয়ে তাদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয় না। মানুষের মাথায় কালো কালো লোম থাকে। তারা সেই লোম ছোট করার জন্য মাসে একবার সেলুনে যায়। মানুষ কানে আমাদের চেয়ে অনেক খাটো। তবে সেই কানে তারটার লাগিয়ে তাদের গান শুনতে দেখা যায়। মানুষ এমনিতে কথা বলতে পারলেও ঘুমালে আর কথা বলতে পারে না। মানুষের মধ্যে একটা জাত আছে, যাদের বলা হয় পশু ডাক্তার। তারা আমাদের কোনো অসুখবিসুখ হলেই সাইকেল নিয়ে দৌড়ে আসে। উপকারী প্রাণী হিসেবেও মানুষ মন্দ নয়। কারণ তারা প্রতিদিন সকালে আমাদের থাকার ঘর পরিষ্কার করে দেয়। এর জন্য কোনো প্রকার চাদা দাবি করে না।
গাভির লেখা রচনা
মানুষ একটা দুগ্ধলোভী প্রাণী। আমার দুধ দোহানোর জন্য তাদের সে কী তাড়না! তবে তারা বেশ রোমান্টিক জীবকুল। আমার গর্ভে বাচ্চা আসার আগে যখন রোমান্টিক ষাঁড়ের সংস্পর্শ পেতে ইচ্ছা করছিল, তখন তারা আমার জন্য অভিসারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মানুষ খুবই ভোজনরসিক। বিশেষ করে যখন সস্তায় এবং ফ্রিতে কোনো কিছু পায়। ফ্রিতে পেলে নাকি তারা আলকাতরাও খেয়ে ফেলতে পারে। তবে আমাদের খইল-কুঁড়া খেতে পারে কি না, সেটা অবশ্য এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তারা ভোজনরসিক হওয়ার কারণে তাদের কারও কারও পেট আকার-আকৃতিতে আমাদের পেটের প্রায় কাছাকাছি চলে যায়। মানুষ পানি খাওয়ার জন্য আমাদের মতো গামলা ব্যবহার না করে গ্লাস বা বোতল ব্যবহার করে থাকে। পা থাকা সত্ত্বেও তারা গাড়ি ব্যবহার করে থাকে। তারা এমনিতে সব সময় দোপায়া সেজে থাকলেও হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচে যাওয়ার সময় চারপায়া সাজে। মানুষকে নিয়ে আরও লেখার ছিল। কিন্তু বাচ্চাটা বড্ড ডিস্টার্ব করছে।
ষাঁড়ের লেখা রচনা
মানুষ গৃহপালিত কঠিন দিলবিশিষ্ট প্রাণী। কারণ এমন কঠিন কাজ নেই, যা তারা আমাকে দিয়ে করায় না। তারপর আবার যখন-তখন ফট করে বাড়ি বসিয়ে দেয় বেত দিয়ে। যা-ই হোক, মানুষের নাক, কান, মুখ— সবই আছে, শুধু আমাদের মতো ডাগর ডাগর চোখ নেই। যেগুলো আছে, তাও অত্যন্ত ক্ষুদ্র। মানুষ গান গাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে তাদের মধ্যকার কারও কারও গান এতটাই আপত্তিকর যে আমরা সেই গান শুনে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার একটা রিস্ক নিয়ে ফেলি। মানুষ তাদের কথাবার্তায় রেফারেন্স হিসেবে গরুর কথা টেনে আনে। যেমন—এই, এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন, বলদের মতো কথা বলবি না তো ইত্যাদি। মানুষের কাছে টিভি নামের একটা যন্ত্র আছে, যা দেখতে দেখতে তারা ঘুমায়। আর তারা ঘুমানোর সময় খুবই সাবধানে ঘুমায়। যে কারণে এক মশারিতেই তাদের চলে যায় ম্যালা দিন। অথচ আমাদের মশারি রাতে টানিয়ে দিলে সকালেই শেষ। তাই আমাদের উচিত মানুষের যত্ন নেওয়া। অন্তত শিঙের আগায় ঝোলানোর অপচেষ্টা না করা।
গাড়িয়াল ভাইয়ের গরুর লেখা রচনা
মানুষ অত্যন্ত বিবাহপ্রবণ প্রাণী। আমাদের দিয়ে গাড়ি বানিয়ে সেই গাড়িতে করে শুধু নতুন বউ আনত। এখন অবশ্য একটু কমেছে। না না, বিবাহ কমেনি, কমেছে আমাদের ব্যবহার। তবে সমস্যা হলো, তারা আমাদের ভাষা বোঝে না। ভাষা শেখার জন্য তারা এত এত কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়, কিন্তু আমাদের মানে গরুর ভাষাটা কেন যে শিখে নেয় না! মানুষ কানকথা বলতে খুব পছন্দ করে। যে কারণে তারা যখন বউ নিয়ে আমার গাড়িতে যায়, তখন খালি কী সব কথা জানি বলত আর আস্তেধীরে হাসত। মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আছে, যারা বাঁশের ফুটায় ঠোঁট লাগিয়ে ফুঁ দেয়। এই জিনিসটাকে অবশ্য বাঁশি বলা হয়। আর যারা ফুঁক দেয়, তাদের বলা হয় রাখাল। ‘রাখাল’ শব্দটা শুনে খালের মতো মনে হলেও এটা কোনো খাল নয়। এ ছাড়া খুশি মনে তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করা যায় না। কারণ আমাদের বুক আর মানুষের বুক কেমন যেন খাপ খেতে চায় না। গঠনটাই কেমন যেন। বেখাপ্পা।
সদ্য জন্ম নেওয়া একটা বাছুরের লেখা রচনা
মানুষ অত্যন্ত ভালো জাতের প্রাণী। তার আমার মতো একটা শিংবিহীন মাথা রয়েছে। হাত-পা তো রয়েছেই। তবে সেগুলো আমার মতো নয়। কারণ সে পায়ে জুতা পরে। হাতে ঘড়ি লাগায়। মোবাইল ফোনও রাখে মাঝেমধ্যে। তার দুটি চোখ রয়েছে। এই চোখের ওপর কেউ কেউ ঢাকনা লাগায়। এই ঢাকনার নাম চশমা। সে আমাকে খুবই খাতির-যত্ন করে। তবে যতই খাতির-যত্ন করুক না কেন, রাতের বেলা আমাকে তার মতো বালিশে শুতে দেয় না। মানুষেরও আমাদের মতো একটা একটা করে বাচ্চা হয়। তবে তারা থাকে জম্মের অলস। আমরা হাঁটি এক ঘণ্টায়, আর তারা এক বছরেও হাঁটতে পারে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মানুষের বাচ্চাদের জন্মের সময় তো লেজ থাকেই না, এমনকি পরবর্তী সময়েও আর গজায় না বলে জানা যায়। মানুষ আমাদের নিয়ে মাঠে গেলেও আমাদের সঙ্গে ঘাস খায় না। তবে কিছু কিছু ঘাস বাড়িতে এনে রান্না করে খায়, যাকে তারা শাক বলে। তাদের গায়ে জামা থাকায় তারা আমাদের মতো যেখানে-সেখানে হিসুটিসু করতে পারে না। এখন পর্যন্ত মানুষকে ভালো জীব বলেই ধারণা হচ্ছে। তবে মায়ের কাছ থেকে পুরো বায়োডাটা নিতে হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৫, ২০১০
Leave a Reply