ভুঁইগড়ে এক অনুষ্ঠানে গেছি। মঞ্চের পাশে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছি। ফজল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা (কবি ফজল মাহমুদ)। দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলাম। হাত ধরে উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর ঠোঁটের হাসি হারিয়ে গেল। চোখে উদ্বেগ ! মায়াভরা বিস্ময়! জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী?
উনি বললেন, আপনি শিগগিরই চিকিৎসক দেখান। আপনার চোখ এত লাল কেন? স্ট্রোক হয়ে যাবে! কী সর্বনাশ! লিপিড প্রোফাইল করিয়েছেন?
ভদ্রলোক চিকিৎসক। তাঁর কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভয়ে আমি সেখানেই বসতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। পেছনের চেয়ার কে যেন সরিয়ে ফেলেছে, দেখিনি। ভারি লজ্জার বিষয়!
লিপিড প্রোফাইলের প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের কোলেস্টেরল পরিমাপ করা। করালাম। চিকিৎসক রিপোর্ট দেখে বললেন, বিপজ্জনক! শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে গেছে। এই চর্বি হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি-সংকটসহ নানাবিধ বড় ঝামেলার কারণ হতে পারে।
চিকিৎসক অনেক নিয়মকানুনের সঙ্গে প্রধান চিকিৎসা দিলেন প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে হাঁটা! হাঁটতে হবে। দুষ্ট কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইডি বার্ন করতে হবে।
ঢাকায় নরমাল ওয়ার্কিং লাইফে হাঁটার উপায় নেই। পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের ১৫০ কিলোমিটার দখল করে রেখেছে হকাররা। পর্যাপ্ত পার্ক নেই। আমার বাসার নিকটতম হাঁটার জায়গা হচ্ছে ধানমন্ডি লেক। চিকিৎসা হিসেবে সকালে ধানমন্ডি লেকে চলে আসি। এখানেও শত-সহস্র মানুষ। নারী-পুরুষ-তরুণ-বৃদ্ধ, অধিকাংশই অসুস্থ। গিজগিজ করে। লেকের পাশেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো। হাঁটার পথগুলো চওড়া করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ বেড়েছে অনেক। গায়ে-গায়ে লাগার অবস্থা। এক গতিতে হাঁটা মুশকিল!
ভিড় এড়ানোর জন্য রোড ৫/এ-র উত্তর দিকের রাস্তা ধরে মেইন রোডে চলে এসেছি। লেকের পাশেই বসার জায়গা আছে। চা নিয়ে একজন বসে আছে। তার সামনে কালো জোব্বা পরা এক লোক কয়েকটা ৫০০ টাকার নোট গুনছে। গোনা ঠিক না, টাকাকে হাতাপাতা করছে। এক হাত থেকে আরেক হাতে নিচ্ছে। এটা যে দেখানোর জন্য করছে, সেটা বোঝা যায়। কোনো ছিনতাইকারী কি না কে জানে! তার পরনের পোশাক বলে দেয়, এটা হাঁটতে আসার ড্রেস নয়। আমার পকেটে তেমন কিছুই নেই। খোয়ানোর ভয়ও নেই। চা খাওয়ার ছলে বেঞ্চের কাছে এসেছি। চাওয়ালা গভীর দৃষ্টিতে ওই লোকের টাকা গোনা দেখছে। ফ্লাস্কের সামনে বিস্কুট, মোয়া আর চকলেটের বয়াম বাঁধা। জোব্বাওয়ালা একটা বিস্কুট নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, বড় ট্যাকার নোট দেইখা কি লোভ হয়?
ছেলেটা কম বয়সী। ২২/২৩ হবে। পরনে নীল রঙের গেঞ্জি। বুকের মধ্যে সাদা রঙে লেখা Love। পায়ে স্যান্ডেল আছে। চেহারা ভরা মায়া। লোকটি বলল, তুমি জোয়ান পোলা, তোমার ফেলাস্কের ফ্যাকটারি দেওয়ার কথা, ভালো কারবার করার কথা, তুমি ফেলাস্কে চা নিয়া ঘুরো ক্যান? এডি তো সব হাসপাতালের চুরি করা পাতার চা! চোরে দেশ ভইরা গেছে!
কী করব স্যার? গরিব মানুষ! পুনজি পাব কই? ঢাকা শহরে চা বেচা ছাড়া উপায় নেই।
এই দেখো, বাঙালির আয়-উন্নতি হয় না ক্যান জানো? বাঙালি পয়লাই খাইতে চায় জিলাপি। আরে মিয়া, পয়লা টার্গেট করবা সন্দেশ। সন্দেশ চাইলে রসগোল্লা পাইবা। রসগোল্লা চাইলে পাইবা আমিত্তি। আমিত্তি চাইলে জিলাপি। আর পয়লাই যদি জিলাপি টার্গেট করো, তাইলে তো জিলাপিও পাইবা না। পাইবা জিলাপির সিরা…পিঁপড়ার ভাগ মারবা। সিরা খাইব পিঁপড়ায়। আহা, বাংলাদেশের মানুষ কী রাক্ষস! পিঁপড়ার খানাও ছাড়ে না! একদল বেশি খায়া চর্বি জমায়া সেগুলা ঝাড়তাছে। আরেক দল পীপিলিকার খাওন নিয়াও কাড়াকাড়ি করতাছে।
লোকটির কথা বলার মধ্যে দারুণ আকর্ষণ আছে। ভালো অভিনেতা হতে পারবে। চাওয়ালা বলল, আমি ট্যাকা পাব কই, স্যার। কারবার করতে কত ট্যাকা লাগে না?
আরে কয় কী! দুই লাখ ট্যাকা ক্যাশ নিয়া ঘুরতাছ আর কও ট্যাকা পাইবা কই, ওপরওয়ালা তো বেজার হইব মিয়া!
জোব্বাওয়ালা বলে কী! চমকানোর কথা! আমি এগিয়ে উত্তর দিকের বেঞ্চে বসলাম। চা দিতে বলে হাতের পেপারে নজর দিলাম। মন আর কান জোব্বাওয়ালার দিকে।
ছেলেটা এদিকে চা দিয়ে বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, আমার কাছে নগদ ট্যাকা দেখলেন কই? আমি ট্যাকা কই পাব?
লোকটা একের পর এক বয়াম খুলে বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে। বলল, শোনো, ওপরওয়ালা সব মানুষরেই কাজকারবার করার জইন্য পুনজি দিয়া দিছে। ডবল ডবল পার্টস দিয়া দিছে। যেমুন ধরো তোমার চোখ! চোখ কয়টা? দুইটা! কিন্তু কাজে লাগে একটা। একটা চোখ দিয়াই কিন্তু সব দেখা যায়। তবু একটা বেশি দিছে। কারণ উনি দয়ালু। আবার কিডনি কয়টা দিছে? দুইটা। একটা কাজে লাগে, আরেকটা স্পেয়ার পার্টস। এই একটা পার্টস বেইচা ফালাও। নগদ দুই লাখ টাকা পাইবা। সেই টাকা দিয়া কারবার করো। মালামাল দিয়া দোকান সয়লাব কইরা ফালাও! এই যে আমার হাতে সাতসকালে বড় বড় ৫০০ ট্যাকার নোট দেখলা, গতকাইল একটা পার্টস বেচছি, সেই ট্যাকা। চাইলে আমার কাছে একটা পার্টস বেচতে পারো!
এতক্ষণ চোরা চোখে দৃষ্টি দেওয়ায় তার মুখ ভালো করে দেখিনি। এবার তাকালাম। অসম্ভব ধূর্ত চোখ! চেহারায় বসন্তের দাগ। পেপার সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী করেন, ভাই?
আপনে তো আমার কথা শুনছেন। জোরেই বলছি, পার্টসের ব্যবসা করি।
আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, পার্টসের ব্যবসা করেন মানে, কিসের পার্টস?
বডি পার্টস। বর্তমানে মানুষের বডি পার্টসের কারবার করি। আর মৌসুম বুইঝা ঢাকায় ফকির ইমপোর্ট করি।
সে নিজেই অবলীলায় বলে যাচ্ছে, রমজান মাসে সারা দেশ থিকা ঢাকায় ফকির আসে পাঁচ লাখ। ট্রেন-লঞ্চ-বাস-ট্রাকে কইরা তাগো বিনা ভাড়ায় আনতে হয়। জনপ্রতি পাই মাত্র দুই টাকা।
প্রথম আলোতেই কিছুদিন আগে একটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, ঢাকায় এখন এক কোটি ৩০ লাখ লোক বাস করে। প্রতিদিন আরও আসছে দুই হাজার ১৩৬ জন করে। এত বাড়তি মানুষ ঢাকায় এসে কী করছে? কী কাজ করবে? এই দিশেহারা মানুষগুলোই আশা দেখে এ রকম লোকের পাল্লায় পড়ে। লোকজন আগে শুধু টাকাপয়সা খোয়াত। এখন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও খোয়াচ্ছে। এই চিত্র ভয়াবহ।
লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী?
শোনেন স্যার, আমি কোনো বেআইনি কাজ করি না যে পুলিশে ধরতে পারব বা র্যাবের ক্রসফায়ার খাব। থানায় আমার নাম নাই। আমি মানুষরে বুঝাই, তাতে উপকার ছাড়া কারও অপকার হয় না। দেশে কাজকর্ম চাকরিবাকরি নাই। মানুষ কী কইরা খাবে? বডি পার্টসডি ফালাই রাইখা নষ্ট কইরা তো লাভ নাই। নিজে বাঁচি, অন্যরেও বাঁচাই!
লোকটি কথা বলে চমত্কার। তার নিজের এক ধরনের যুক্তিও আছে। আমার সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। যাওয়ার জন্য উশখুশ করছে। তাকে আটকানোর জন্য কায়দা করে প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করলাম, নাটক করবেন?
সে হাসল—জীবনের চেয়ে বড় নাটক আর কিছু আছে? সারাক্ষণই তো সক্কলে নাটক করতাছি!
বলেই উঠে চলে গেল!
আবু সুফিয়ান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৯, ২০১০
Leave a Reply