কেস স্টাডি – এক
কাদের সাহেব (আসল নাম নয়) ব্যাগ নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাত্ রাস্তার পাশের পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নিচে পাবলিকের ভিড় দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। সবাই ওপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। কাদের সাহেবও ওপরের দিকে তাকালেন। ছাদের কার্নিশে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই পাঁচতলা থেকে সোজা নিচে পড়ার প্রবল আশঙ্কা। কাদের সাহেব উপস্থিত একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই সাহেব, বিষয় কী?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘তিনি ছ্যাঁকা খেয়েছেন, তাই আত্মহত্যা করার জন্য ছাদে উঠেছেন।’ কাদের সাহেব বললেন, ‘আপনারা তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন না?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘সবাই তাকে নেমে আসার জন্য বলছে, কিন্তু সে নামতেই চাইছে না।’ কাদের সাহেবের মনটা খুব খারাপ হলো। এমন তরতাজা নওজোয়ানেরা তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে দেখে তাঁর মন ব্যথায় ভরে গেল। ব্যথার জন্য পাশের ফার্মেসি থেকে একটা পেইনকিলার খেয়ে ছেলেটাকে কীভাবে বাঁচানো যায় সে চিন্তা শুরু করলেন। আইডিয়া পেতে দেরি হলো না। কাদের সাহেব ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন গাধার বাচ্চা ছাদে উঠেছে রে?’ ওপর থেকে জবাব এল, ‘গালাগালি করে কে রে?’ কাদের সাহেব আবার বললেন, ‘আমি গালাগালি করি। গালাগালি করলে তুই কী করবি হারামজা…?’ ‘দেখেন, ভদ্রলোক মানুষ, মুখ খারাপ করবেন না। আমি নেমে আসলে কিন্তু অবস্থা খারাপ করে ফেলব’! জবাব এল আত্মহননকারীর কাছ থেকে। কাদের সাহেব এবার আসল বোমাটা ছাড়লেন, ‘তোর এত বড় সাহস, আমাকে হুমকি দিস! কু… …চ্চা, সাহস থাকলে সামনে এসে দেখ।’ ব্যস, এতেই কাজ হলো। আত্মহননকারী আত্মহত্যার চিন্তা বাদ দিয়ে কাদের সাহেবকে ধরতে সিঁড়ি দিয়ে হড়হড় করে নামতে শুরু করল। এই ফাঁকে কাদের সাহেব দিলেন দৌড়। সেই আত্মহননকারী আজও বেঁচে আছে। কাদের সাহেবকে শিক্ষা না দিয়ে সে মরবে না বলে পণ করেছে।
কেস স্টাডি – দুই
আতর আলী (ছদ্ম নাম) পেশায় ভিক্ষুক। কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে তিনি বসেন। এ ছাড়া তাঁর তিনটা বেয়ারিংয়ের চাকার ঠেলাগাড়ি আছে। রোজ ৩০ টাকা রেটে গাড়িগুলো অন্য ভিক্ষুকদের তিনি ভাড়া দেন। পাঁচ ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলের বয়স আট বছর। আতর আলী যেখানে বসেন, তাঁর পেছনে মতিন মিয়ার (এটাও ছদ্ম নাম) ফলের দোকান। কাছাকাছি কর্মস্থল হওয়ায় আতর আলী ও মতিন মিয়ার প্রতিদিনই দেখা হয়। মতিন মিয়া খেয়াল করলেন, আজ আতর আলীর সঙ্গে ভিক্ষা করতে সাত-আট বছরের একটি বালকও এসেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী আতর আলী, পোলাডা কে?’ আতর আলী বললেন,‘ আমার বড় ছেলে। আজ থেকে অরেও কামে লাগাইয়া দিলাম।’ মতিন মিয়া অবাক, ‘কী বল আতর আলী, তাহলে ওর লেখাপড়া?’ আতর আলী বললেন, ‘লেখাপড়া কইরা কী হইব? লেখাপড়া ছাড়াই আমাগো ইনকাম খারাপ না। খালি খালি ইস্কুলের বেতন দিতে যামু ক্যা?’ মতিন মিয়ার মনটা খারাপ হলো। একটা বাচ্চা লেখাপড়া ছেড়ে ভিক্ষা করবে, সেটা তাঁর ভালো লাগল না। ছেলেটাকে কীভাবে স্কুলে পাঠানো যায়, সে বিষয়ে তিনি মনে মনে ফন্দি করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বুদ্ধিও চলে এল। তিনি ছেলেটাকে ডাক দিলেন, ‘এই ফকিরের বাচ্চা ফকির, তোর নাম কী?’ এভাবে ডাকতে দেখে ছেলেটার ভ্রু কুঁচকে গেল। সে তার বাবাকে বলল, ‘বাবা, ওই লোকটা আমাকে গালি দিয়ে ডাকল কেন?’ বাবা বললেন, ‘এটা তো গালি না, এটাই আমাদের পদবি। যাও, কাকু কী বলে শুনে আসো।’ ছেলে বলল, ‘যে কাজের পদবি একটা গালি, সে কাজ আমি করব না। আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দাও। আমি লেখাপড়া করে ভালো কাজ করব, যেন কেউ আমাকে ফকিরের বাচ্চা ফকির বলতে না পারে।’
সেই ছেলেটি আজ একটি প্রাইভেট ব্যাংকের উচ্চপদে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞের মতামত
গালি আমাদের জীবনযাত্রাকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সে সম্পর্কে জানতে আমরা শরণাপন্ন হয়েছিলাম এ খাতের বিশেষজ্ঞ জনাব লোকমান মোল্লার কাছে। তিন বলেন, গালি আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজের উন্নতির পেছনে গালির অবদান অপরিসীম। আমার কথাই বলি, একসময় আমি কোনো কাজ করতাম না। বাসায় বসে বিটিভিতে জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠানে সাংসদদের গালাগালি ও বকাঝকা দেখে সময় কাটাতাম। কোনো কাজ না পেয়ে যখন হাঁপিয়ে উঠেছি, তখন আমার স্ত্রীর পরামর্শে গালাগালি-বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রেরণা পাই। সেই থেকে আর আমি বেকার নই। এই দেখুন, এ খাতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে আপনি আমার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছেন। একইভাবে নতুন সাংসদ, যাঁরা গালাগালিতে এক্সপার্ট নন, তাঁরাও আমার কাছে আসেন। সংসদে কীভাবে গালাগালি মিশিয়ে বক্তব্য দিতে হবে তার পরামর্শ চান। সে কারণে আজ আমার ইনকাম ভালো। গালাগালি আমার বেকারত্ব দূর করেছে। সুতরাং, আমি মনে করি, গালাগালি দিয়ে যদি ভালো কিছু হয়, তবে গালাগালি, ভালো।
মেহেদী আল মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৫, ২০১০
Leave a Reply