মহাখালী যাব। কোনো সিএনজি যেতে চাইছে না। আগে সিএনজির দুই পাশ খোলা ছিল। লাফ দিয়ে উঠে পড়তাম। এরপর চালকের সঙ্গে বাতচিত্ হতো। এখন সেটা সম্ভব না। গাড়ির দুই দিকেই দরজা আটকানো। তাঁরা ‘যাবে না’ বলেই গাড়ি নিয়ে টান দেয়। খানিকক্ষণ পেছনে ছোটা যায়, কিন্ত ধরা যায় না। অথচ ট্রাফিক পুলিশের একটা আইন আছে—সিএনজি, ক্যাব যেকোনো জায়গায় যাত্রীদের নিয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশে আইন মানাতে হয়, মানে না কেউ সহজে। আমি নিরুপায় হয়ে এই মানানোর কাজটা মাঝেমধ্যেই করি! সিএনজিওয়ালাদের জিজ্ঞেস করি, আইন আছে, যাবে না কেন?
প্রায় সব সিএনজিওয়ালা একই রকম উত্তর দেয়। বলে, গ্যাস নাই। গ্যাস নিতে যাব! কেউ বলে, গাড়ির কাজ করাইতে হইব। কিংবা কেলাসের (ক্লাচের) তার ছিঁইড়া গেছে! দেখেন না, হাতে কালি। কেউ কেউ হাতে কালিও মাখিয়ে রাখে। বলে, বেরেক ডিস্টাব! রিস্ক নিয়া উঠবেন?
আমি বলি, উঠব। রিস্ক নিয়েই উঠব এবং সত্যি সত্যি উঠি! সিএনজিওয়ালা তখন বিপদে পড়ে যায়। ভয় দেখানোর জন্য রাস্তার মধ্যে গাড়িকে ঝাঁকাঝাঁকি করে। তীব্র রাগে মাঝেমধ্যে হার্ডব্রেক করে কড়া ধাক্কা খাওয়ায়! আমি খুশি কণ্ঠে বলি, তুমি তো খুবই ভালো চালক! গাড়ি নিয়ে রাস্তায় কী সুন্দর নাচানাচি করো। শিল্পী-চালক! নাটক-সিনেমা করতে পারবে। ভালো আর্টিস্ট! এগুলো শুনে চালকের গা জ্বলে। কিন্তু শয়তানিটা তত্ক্ষণাত্ কমে।
২.
আরেক দল চালক আছে, যারা ইচ্ছামতো ভাড়া চায়। আগে বলত, মিটারের চেয়ে দশ-বিশ টাকা বাড়িয়ে দিয়েন। এখন বলে, গাড়িতে মিটার রেখেছে শুধু সরকারের আইন মানতে। মিটার চলবে। কিন্তু ভাড়া নেবে চুক্তিতে। ধানমন্ডি থেকে গুলশান যাব। ভাড়া দুই শ টাকা।
দুই শ টাকায় তো এসি ক্যাবেই যাওয়া যায়! সিএনজিতে যাব কেন?
এসি ক্যাব অহন ঘণ্টা হিসেবে প্যাসিঞ্জার নেয়। ঘণ্টা আড়াই শ ট্যাকা। জ্যাম পার হয়্যা গুলশানে যাইতে লাগব কমপক্ষে এক থিকা দেড় ঘণ্টা! ভাড়া উঠব আরাই শ থিকা সাড়ে তিন শ…! ট্যাকার শুলানি থাকলে যান।
কৌশলের সঙ্গে কৌশল করতে হয়। বললাম, চলো। উঠে ড্রাইভারের সঙ্গে খুবই টক-মিষ্টি কথা বলি। মিটারে ভাড়া এসেছে এক শ দশ টাকা। নেমে এক শ দশ টাকাই দিলাম। সিএনজিঅলা বলল, দুই শ টাকা কয়া আসছেন। দুই শ ট্যাকা দিবেন! এইডা কী দিলেন? বললাম, আইন দিলাম! তুমি যেমন আইন মানার জন্য কৌশল হিসেবে মিটার রেখেছ, আমিও কৌশল হিসেবে তোমার ভাড়ায় রাজি হয়েছি। মিঠা কথা বলেছি। কিন্তু ভাড়া দিলাম আইন মেনে, মিটারে। পছন্দ না হলে তুমি পুলিশ ডাকো।
চালক ক্রুদ্ধ হয়েছে। বলল, সরকারে আইন করছে, মালিকেরা গাড়ির জমা নিব চাইর শ ট্যাকা। কিন্তু মালিকেরা নিতাছে আট শ ট্যাকা! আমরা কই পাব? চুরি করব?
ড্রাইভারের কথার যুক্তি ঠিক আছে। কোথায় যেন একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। ভালো লাগে না! এর একটা সুস্থ সমাধান দরকার।
৩.
বাংলাদেশে পুলিশের ইমেজ খুব একটা উজ্জ্বল না। ট্রাফিক বিভাগের ভাবমূর্তি দুর্বল, তবে কিছুকাল যাবত্ তারা একটি প্রশংসনীয় কাজ করছে। চব্বিশ ঘণ্টার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। এখন মাঝেমধ্যেই সেই নম্বরে ফোন করি। তাতে সিএনজি ক্যাবওয়ালাদের যন্ত্রণার খানিকটা উপশম হয়।
ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের ০১১৯৯৮০৬১১১ ও ০১১৯৯৮০৬২২২—এই দুটা নম্বরে রাস্তার যেকোনো সমস্যা ফোন করে জানালে সঙ্গে সঙ্গে তারা নিকটস্থ পুলিশ সার্জেন্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কখনো কন্ট্রোল রুম থেকেই ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করে। আমি একাধিকবার উপকার পেয়েছি। আবার সাংঘাতিক লজ্জার মধ্যেও পড়েছি একবার!
সন্ধ্যার পরে সিএনজিওয়ালারা ছেলে যাত্রীদের তুলতে গড়িমসি করে। আবার শুধু মেয়ে প্যাসেঞ্জার হলে সহজেই রাজি হয়ে যায়। আমার নাটকের এক কিশোরী শিল্পী আছে। ইউনিটের সহকারী পরিচালক তাকে সিএনজিতে নিয়ে আসে এবং শুটিং শেষে পৌঁছে দেয়। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় তারা বিপদে পড়ে। কোনো গাড়ি যেতে চায় না। বুদ্ধি বের করা হলো, আমার স্ত্রী কিশোরী শিল্পীকে নিয়ে সিএনজি ঠিক করবে। সহকারীদের নিয়ে আমি ঝিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ হাসপাতালের কাছে দাঁড়ালাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুহূর্তেই তারা রামপুরা যাওয়ার সিএনজি পেয়ে গেল। ড্রাইভারের বয়স হবে ৩০-৩২। ওরা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল। দুই সহকারী সিএনজিতে উঠবে, তখন ড্রাইভার বলল, তার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। যাবে না।
তাকে পাকড়াও করলাম। এ কোন ধরনের শয়তানি! অনেকের কাছে শুনেছি, সিএনজিতে মেয়েরা একা থাকলে ড্রাইভার তাদের ভয় দেখায়। ফাজলামি করে। তাই ছেলেরা সঙ্গে যাচ্ছে দেখে, এখন সে যেতে চাইছে না। সন্ধ্যা সোয়া সাতটা। ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। কন্ট্রোল রুম থেকে বলল, অপেক্ষা করেন, সার্জেন্ট পাঠাচ্ছি। ড্রাইভারকে আজ উচিত শিক্ষা দিব। এর মধ্যে ড্রাইভারও দেখি নানা জায়গায় ফোন করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাবের দু-তিনজন ড্রাইভারও তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আমি আবার কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। বলল, সার্জেন্ট আসছে। ফাজিল ড্রাইভার দল ভারী করে প্রস্তাব করল, তার গাড়িটা এখন পেছন থেকে ধাক্কা দিলে স্টার্ট নেবে। আমি কোনো জবাব দিলাম না।
প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। বারবার কন্ট্রোল রুমে ফোন করছি, এত সময় কখনোই লাগে না। সার্জেন্ট চলে আসে। আমি আবার ফোন করলাম। ঘটনাটা আবার বললাম। তখন কন্ট্রোল রুম থেকে বলল, সরি! রাত আটটা পর্যন্ত আমাদের এই সার্ভিসটা চালু থাকে। আটটা বেজে গেছে। এখন আর সার্ভিসটা দেওয়া যাবে না! সেই সন্ধ্যায় আমি ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম!
৪.
আজও ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের সাহায্যে সিএনজি নিয়েছি। ড্রাইভার বাধ্য হয়ে আমাকে মহাখালী নিয়ে যাচ্ছে। মাঝবয়সী লোক। যেতে যেতে সারা পথই অনবরত গালিগালাজ করছে। খুবই বিচ্ছিরি গালি। তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট গালি হচ্ছে কুত্তার ছাও (বাচ্চা) এবং শুয়োরের ছাও! গালি দিয়ে আবার ভেতরের আয়নায় চোরা চোখে তাকাচ্ছে, যেটাতে পেছনের যাত্রীকে দেখা যায়। সে আমার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে। বললাম, আপনি এত গালিগালাজ করছেন কেন?
সে রাগকণ্ঠে উত্তর দিল, আমার মুখ, আমি গালি দিতাছি। বাংলাদেশ সরকারের তো কোনো আইন নাই যে গালি দিলেও আপনে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করবেন! নাকি আইন আছে? থাকলে ফোন করেন পুলিশেরে।
না। এ রকম কোনো আইন নাই। আপনি যত ইচ্ছা গালি দেন।
এবার সে আরও কঠিন এবং কুিসত ধরনের গালাগাল শুরু করল। মহাখালী এসে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মা-বাবা আপনার সঙ্গে এমন কী অন্যায় করেছে যে আপনি তাদের ওপর এত বিরক্ত?
সে ছ্যাঁত্ করে উঠল, মা-বাপের উপর বিরক্ত হমু ক্যান? বিরক্ত প্যাসিঞ্জা খা…র বাচ্চাগো উপরে! সে আরেকটা গালি দিল! মা-বাপ নিয়া কথা কইবেন না।
আমি বললাম, কেউ যদি কাউকে অমুকের বাচ্চা, তমুকের বাচ্চা বলে গালি দেয়, সেই গালি গালিদাতার মা-বাবার উপরেই বর্তায়। অর্থাত্ নিজের মা-বাবাকে গালি দেয়ার পাপ হয়। সারা রাস্তায় আপনি ম্যালাগুলো পাপ করেছেন। নিজের মা-বাবাকে গালি দিয়েছেন। কিতাবের কথা বললাম। ভাড়াটা নেন।
টাকা দিয়ে চলে আসছি, ড্রাইভার নমিত কণ্ঠে স্যার স্যার বলে ডাকছে। আমি ঘুরে দেখে আরও জোরে হাঁটা শুরু করলাম। সেও দ্রুত পায়ে ছুটে আসছে!
রাস্তায় সব সময় সিএনজিওয়ালাদের পেছনে ছুটি। আজ প্রথম সিএনজিচালক আমার পেছনে ছুটছে!
আবু সুফিয়ান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৫, ২০১০
Leave a Reply