সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ব্রাত্য রাইসু বিরচিত যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক নামের উপন্যাসটি নিয়ে সিরিয়াস আলোচনায় যাওয়ার বিপদ হতে পারে এমন যে এ দুই সুরসিক মানুষ আলোচককে বেরসিক ভেবে মন খারাপ করতে পারেন। মানুষে মানুষে যোগাযোগ যে একটা জটিল সমস্যাপূর্ণ বিষয়, তা মনোবিশ্লেষক, ভাষাবিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা যুগে যুগে টের পেয়েছেন, এখনো টের পাচ্ছেন। ‘মানুষ মূলত একা’—এ এক গভীর দার্শনিক অভিজ্ঞতা। দুই লেখক—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ব্রাত্য রাইসু—তাঁদের যৌথভাবে রচিত উপন্যাসটিতে এই গভীর অভিজ্ঞতা নিয়েই কারবার (ডিল) করেছেন। এখানে যুবক আবদুর রাজ্জাক, তার বস অটোমোবাইল ব্যবসায়ী বদরুদ্দীন মণ্ডল, সাপাহার কলেজের বাংলার অধ্যাপক করুণানিধি, তাঁর একদা মার্কসবাদী (এমাবাদী) বন্ধুটি, চোর ও প্রবচনকার আকলিমুর রহমান, নগরবাড়ী ঘাটের এক চায়ের দোকানের বয় হাশেম, ট্রাকচালক আবদুল খালেক, সাপাহারের সরফরাজ খান ও তাঁর তিন কন্যা, ঢাকার আধেক-নারীবাদী তরুণী মালিনী, কবি মুনওয়ার আহমদ প্রমুখ—সকল চরিত্রই একা মানুষ; এবং তাদের আন্তযোগাযোগে সুগভীর সমস্যা রয়েছে। এমনকি একই কাহিনির দুই লেখক, যাঁরা নিজেদের সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী ঘোষণা করে পালাক্রমে অভিন্ন কুশীলবদের নিয়ে কাহিনি বলেন ও ডিসকোর্স করেন, তাঁদের মধ্যেও যোগাযোগের সমস্যা প্রকট। তাঁরা সব সময় পরস্পরকে ঠিকমতো বুঝতে পারেন না, একটি চরিত্র সম্পর্কে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কতটা জানেন, ব্রাত্য রাইসুর তা জানা নেই বলে সৈয়দ সাহেবের ধারণা। একইভাবে ‘আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে অনেক হয়েছে। এবার বেচারাকে নিস্তার দেওয়া আবশ্যক’ বলে ব্রাত্য রাইসু যখন উপন্যাসের এই প্রধান চরিত্রটিকে মেরে ফেলার কথা ভাবেন, তখন তাঁর মনে হয় এ জন্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু সৈয়দ সাহেব সে-অনুমতি দেবেন বলে ব্রাত্য রাইসুর মনে হয় না। তবে শুধু অনুমতির অভাবেই যে তিনি আবদুর রাজ্জাককে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন না, তা নয়। কারণ তাঁর উপলব্ধি: ‘উপন্যাসের এই অবস্থায় নায়ক মরে গেলে উপন্যাস আগাবে কী করে? আর সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও উপন্যাসের তো আগানো দরকার।’
এইভাবে, ঘটনা ও কাহিনি বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি করতে করতে তাঁরা দুজনে মিলে ২৩৯ পৃষ্ঠার একখানা বই লিখে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। বাংলা ভাষায় এ রকম জিনিস পড়ার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। এখানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই হাজির, যা আমাদের খুব পরিচিত: তিনি যে উপন্যাস রচনা করছেন—এই সত্য কথাটা তিনি পাঠককে বারবার জানাচ্ছেন। আর মূলত কবি ব্রাত্য রাইসুকে এখানেই প্রথম বিশদভাবে পাওয়া গেল কাহিনিগদ্যের লেখক হিসেবে। কবিতায় যেমন, এখানেও তেমনি, তাঁর তীক্ষ রসবোধের পরিচয় সুস্পষ্ট।
ঢাকার ফকিরেরপুলের মণ্ডল কার সেন্টারের কর্মচারী আবদুর রাজ্জাক তার স্ত্রী-পরিত্যক্ত মালিক বদরুদ্দীন মণ্ডলের জন্য পাত্রীর সন্ধানে ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনদাতা পাঁচু ময়রার উদ্দেশে বাসযোগে নওগাঁর সাপাহারের উদ্দেশে যে যাত্রা করে, উপন্যাসের শুরুতে তার বিবরণেই হিউম্যান কমিউনিকেশনের গভীর সমস্যা পরস্ফুিট। কিন্তু কোনো ধরনের সমস্যাই আদতে উপন্যাস-পাঠকের প্রধান আগ্রহের বিষয় থাকে না, বরং ঘটনা বা কাহিনির টানই তাকে উপন্যাস-পাঠে ধরে রাখে—এ কথা সম্ভবত লেখকদ্বয়ের বিলক্ষণ জানা ছিল। তাই আমরা এখানে তাঁদের বর্ণনায় আখ্যানের ঘাটতি দেখি না। আবার, প্রচলিত ধারার কাহিনি বর্ণনার মধ্যে ফুরিয়ে না গিয়ে তাঁরা তাঁদের বর্ণনার ভাষায়, ভঙ্গিতে ও সুরে আরও এমন কিছু বিষয় যুক্ত করেন, যা পাঠককে আমোদিত করে। সুরটা আগাগোড়া রসিকের। অরসিক কোনো ব্যক্তির জন্য এ উপন্যাস বিরচিত হয়নি।
যেসব লেখক সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বরের মতো মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কাহিনি রচনা করেন, তাঁরা কখনো পাঠকের সামনে স্বমূর্তিতে হাজির হন না। তাঁরা কাহিনির পাত্রপাত্রীদের ভিতর-বাহিরের সমস্ত কিছু জানেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ব্রাত্য রাইসু এহেন পাঠক-ভোলানো পথে না এগিয়ে পরিষ্কার বলেছেন, এবং তা বারবার, যে, তাঁরা দুজনে মিলে একটি উপন্যাস রচনা করছেন। সেই অর্থে যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক একটি উপন্যাসের লিখন-প্রক্রিয়ারও বিবরণ বটে। এখানে তাঁরা দুজনেই সশরীরে হাজির। তাঁরা সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বর নন, আবদুর রাজ্জাক ও অন্যরা তাঁদের সৃজিত চরিত্র নয়—বরং লেখকদ্বয় ও চরিত্রসকল মিলেই এ উপন্যাস।
এইখানে একটা মুশকিল হলো এই যে, সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাসম্পন্ন না সাজলে একই কাহিনির চরিত্র হয়ে অন্যান্য চরিত্রের সমুদয় ক্রিয়াকলাপ ও মনের সব খবর জানা লেখকের পক্ষে কী করে সম্ভব? ব্রাত্য রাইসুর ভাষ্য অনুযায়ী যে-দুই সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী এই কাহিনি-ডিসকোর্স রচনা করেছেন, আবদুর রাজ্জাকদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কী?
এটা বাস্তবিক যুক্তির প্রশ্ন। যে পাঠক (বা আলোচক) এই প্রশ্ন তুলবে, তাকে অরসিক বলতে হবে, কারণ সে যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোকের বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের কাহিনি, এবং তা নিয়ে দুই সুরসিক, শিক্ষিত, আধুনিক, নাগরিক এবং বিচ্ছিন্ন মানুষের রসিকতা উপভোগ করতে জানে না। বাস্তবিক মানবিক ও সিরিয়াস দার্শনিক সমস্যা নিয়ে লেখা এ উপন্যাস একান্তভাবেই রসিকদের জন্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply