নারীর সঙ্গে নারী-পুরুষ উভয়েরই জন্মসূত্রে নাড়ির যোগ। নাড়ির টানে বিশ্ব মা দিবস, বিশ্ব নারী দিবসে দুনিয়া জোড়া কত শত ঘটার বাহার। মাতৃদুগ্ধ দিবস, শিশু দিবস, টিকা দিবস এগুলোও ঘুরেফিরে নারীর কোলঘেঁষা। সব মিলিয়ে গোনায় ধরলে নারীর জন্য বছরজুড়ে নামে-বেনামে হাজারে-বিজারে দিবসের ছড়াছড়ি। অথচ দুনিয়ার ওপর একটি পুরুষ দিবসের বড্ড আকাল। গত শতকের ষাটের দশক থেকে একটি পুরুষ দিবস বরাদ্দের দাবি ‘আর কটা দিন সবুর কর’ ছুতায় আজও ঝুলে আছে। হাজারটা দেন-দরবার মিছিল-মিটিং শেষে বছরের ৩৬৫ দিন থেকে পুরুষ একটা মাত্র দিবস তাদের কপালে এখনো জোটাতে পারল না। পুরুষের এমন ব্যর্থতার গ্লানির কথা মুখ বুজে হজম করা এখন সত্যি কঠিন। আবার কার্যকারণ খতিয়ে না দেখে একটি দিবস আদায়ের ব্যর্থতার দায় পুরুষের ওপর একতরফা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক সততার পরিচয় নয়। বরং সততার সঙ্গে ইতিহাসের পরতে পরতে এ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করাই ন্যায়সংগত।
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী পুরুষ দিবস আদায়ের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, সৃষ্টির গোড়ায় এক গুরুতর গলদ। সৃষ্টির দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবতাদের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে অনাসৃষ্টির শেষ নেই। বিশ্বে একটি পুরুষ দিবসের অনুপস্থিতির জন্য আসলে পাশ্চাত্যের দেবতা জিউস দায়ী। দেবতা জিউস একসময় স্বর্গের জীবনে বিরক্তিকর একঘেয়েমিতে ভুগছিল। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একদিন সে মাটির ঢেলা নিয়ে খেলতে খেলতে দেবীদের খুব কাছাকাছি গড়নের একটি প্রাণী সৃষ্টি করে তার নাম দিল মানবী। মাথা ভরা বুদ্ধি আর গা ভরা রূপ ঢেলে দিয়ে জিউস মানবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে স্বর্গের বাগানে ছেড়ে দিয়ে নিজের রাজ্যপাট নিয়ে আবার মেতে উঠল। মহাবিশ্বের হাজারো ঝামেলায় জিউস একসময় মানবীর কথা ভুলেও গেল। মানবীও রইল স্বর্গের বাগানে দিব্যি নিজের মনে একা একা।
এর মধ্যে মিলিয়ন বছর পেরিয়ে গেছে। স্বর্গের বাগানে এমন নিঃসীম নির্জনতায় মানবীর সময় আর কাটে না। দিনভর অলস বেলায় হাই তুলে তুলে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে মানবী ক্লান্ত-বিষণ্ন। একদিন বাগানের নিঃসঙ্গ নিরালা কোণে বসে মানবী ক্লান্ত গলায় জিউসকে ডেকে বলে, ওগো জিউস, চারপাশের নিঃশব্দ নির্জনতায় আমার বড় একা লাগে। এখন আমার দিন কাটে তো রাত কাটে না। তুমি একটা কিছু বিহিত করো গো জিউস।
সৃষ্টির হরেক ঝকমারিতে ব্যস্ত জিউস মানবীর ডাক শুনেও না শোনার ভান করে। কিন্তু নারী নাছোড়বান্দা। দিনে দিনে সেও গলা চড়ায়। ক্ষণে-বিক্ষণে সে জিউসকে হেঁকে ডেকে জানান দিয়ে বলে, এত নির্জনতার ভার আর তো সয় না। বড় বেশি একা একা লাগে। একটা কিছু উপায় করো জিউস।
নারীর ডাকাডাকিতে ত্যক্ত অকুলান জিউস হাতের হাজারটা কাজ ফেলে স্বর্গের বাগানে এসে বলে, নারী, তোমার সমস্যা কী? স্বর্গের বাগানে এত অঢেল থাকতে দিনভর এমন হাপিত্যেশ করে মরছ কেন?
জবাবে নারীর সেই পুরোনো গঁত্,—বড্ড একা লাগে। এত একাকিত্ব কাঁহাতক জানে সয়!
খানিক চুপচাপ থেকে জিউস নারীর সমস্যা হূদয় দিয়ে বোঝে। বলে, শোনো হে নারী। আমার বড় তাড়া। আমি তোমাকে বেশি সময় দিতে পারব না। বরং তোমার আদলে তোমার কাছাকাছি গড়নের একটি প্রাণী গড়ে তোমাকে দোকলা করে দিচ্ছি। তার সঙ্গে তুমি হেসে-কেঁদে খুনসুটি করবে—দেখবে সারাজীবন সে তোমার পায়ে পায়ে ফিরবে।
সুখের কথা শেষ না করেই জিউস তড়িঘড়ি খানিক কাদামাটি ছানতে নেমে পড়ে। বিগব্যাঙ হয়ে মহাবিশ্বের পরিধি অনেক বেড়ে যাওয়ায় জিউসের হাতে আগের মতো অঢেল সময় নেই। হাতের হাজারটা কাজ ফেলে নারীর শখ মেটাতে জিউসের সাত-তাড়াতাড়ি এই বাগানে আসা। নারীর সঙ্গে হাসি-মশকরার ফাঁকে খানিক যত্ন, খানিক রগড় মিশিয়ে জিউস বড়সড় গড়নের একটা দোপেয়ে প্রাণী দাঁড় করিয়ে ফেলে। হাতের কাজ শেষে নারীকে ডেকে বলে, শোনো গো নারী, নতুন গড়া এই দোপেয়ে মূর্তির নাম দিলাম ‘পুরুষ’। ওর মধ্যে প্রাণ ঢেলে জ্যান্ত করে তোলার আগে তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে রাখি। তুমি বুদ্ধিমতী। বিষয়টি তুমি বুঝবে ও জন্ম-জন্মান্তরে মনে রাখবে। তোমাকে সযত্নে গড়তে গিয়ে আমার বুদ্ধির ভাণ্ডে এখন ছুঁচোর কেত্তন। পাত্রে এক ফোঁটা বুদ্ধি আর অবশিষ্ট নেই। অথচ এমন বড়সড় গড়নের প্রাণীটার মাথা একেবারে ফাঁপা শূন্য রাখা ঠিক হবে না। মাথাটা ফাঁপা, হালকা থাকলেও যখন-তখন ঢলে গড়িয়ে তোমার গায়ের ওপর পড়ে যাবে। কাজেই ওর মাথাটা আমি বেশ খানিক নিরেট হামবড়ামি ঠেসে ভরে দিলাম। প্রাণ পাওয়ার পরে ও যখন পিটপিট করে চোখ মেলবে, তখন তুমি ওকে বুদ্ধি করে সাজিয়ে-গুছিয়ে বলবে, জিউস পুরুষকে আগে সৃষ্টি করেছে। পরে পুরুষের আদলে সৃষ্টি করেছে নারী। ও তোমার কথা শুনবে। দেখবে এই এককথায় কেল্লাফতে। এই ফাঁপা মাথার দোপেয়েটা ওর মেল শোভেনিজম অর্থাত্ সরল বাংলায় যাকে বলে ‘ব্যাটাগিরি’ সেটা নিয়ে ও মত্ত থাক। তুমি তোমার চিকনবুদ্ধি দিয়ে দুনিয়াদারির কলকাঠি চিরকাল ইচ্ছেমতো নাড়তে থাক।
পরের ঘটনা দিনের আলোর মতো একেবারে স্পষ্ট—সবারই জানা। মিলিয়ন বছর ধরে হাপিত্যেশ করে পুরুষ আজও একটি পুরুষ দিবস বাগাতে পারল না। ব্যর্থতার দায় পুরুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নাহক-অন্যায়। আহা রে! বেচারার মাথায় যে বুদ্ধি নেই।
তুষার কণা খোন্দকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৮, ২০১০
Leave a Reply