সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী মানে দীর্ঘ ছয় বছর একেকজন ক্যাডেটকে কাটাতে হয় তাদের কলেজ ক্যাম্পাসে। এ সময় ঘটে নানা মজার ঘটনা। তার কিছু এখানে শেয়ার করেছেন কয়েকজন সাবেক ক্যাডেট। লেখাগুলো ক্যাডেট কলেজ ব্লগের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
সেবার আমাদের ক্যাডেট কলেজের খোলা জায়গায় বাঁধাকপি লাগানো হলো। হয়েছিল বাম্পার ফলন। যেদিকে তাকাই খালি বাঁধাকপি আর বাঁধাকপি। দেখলে চক্ষু জুড়ায় না, আতঙ্কে বুক কাঁপে। কে খাইব এত বাঁধাকপি।
আতঙ্ক যে সঠিক, দ্রুতই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সকালে আমাদের দেওয়া হতো তিন দিন পাউরুটি আর তিন দিন পরোটা। আমরা দেখলাম, পরোটার সঙ্গে বাঁধাকপি ভাজি। আর যেদিন পাউরুটি সেদিন বাঁধাকপি সেদ্ধ, ওপরে গোলমরিচ দেওয়া। ১০টায় ছিল টিফিন ব্রেক। মানে হলো এক কাপ দুধ আর সঙ্গে শিঙাড়া, গজা বা এ জাতীয় কিছু। নতুন যুক্ত হলো বাঁধাকপি সেদ্ধ। দুপুরে ভাতের সঙ্গে বাঁধাকপি ভাজি, মাংস থাকলে সেটাও বাঁধাকপি দিয়ে রান্না করা। এমনকি একদিন অবাক-বিস্ময়ে দেখলাম, ডালের মধ্যেও বাঁধাকপি। রাতের খাবারেও একই মেন্যু। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে খেতে যত দিন বাঁধাকপি ছিল, তত দিন।
সেই যে আমি বাঁধাকপি খাওয়া ছেড়েছি আজ পর্যন্ত আর খাইনি। এখনো বাঁধাকপি দেখলে আমার অসহ্য লাগে। আমি খাই না।
শওকত হোসেন, বরিশাল ক্যাডেট কলেজ [১৯৭৯-৮৫]
একদিন হঠাত্ ক্লাস টাইমের নৈঃশব্দ খান খান করে ভেঙে পড়ল করিডোরে পদার্থ স্যারের চিত্কার আর হ্যান্ডস ডাউনরত কারও একজনের পশ্চাদ্দেশে ঠাশ ঠাশ করে ডাস্টারের বাড়ির শব্দে। কী হলো? কী হলো? ঘটনা আর কিছুই নয়, অপরাধী আইনস্টাইনের সূত্র ভুল প্রমাণ করার মতো বিশাল কাজ করে পাক্ষিক পরীক্ষার মতো একটা ক্ষুদ্র ব্যাপারে ফেল করেছে।
ক্যাডেটদের ওপর মাঝেমধ্যে ইংরেজিতে কথা বলার বাধ্যবাধকতা খুব করে চেপে বসত। আর ছোট ক্লাসের ক্যাডেটদের জন্য সব বাংলা শব্দের ইংরেজি খুঁজে পাওয়াও এক মহাকষ্টকর ব্যাপার। কেন মারামারি করেছে, ক্লাস সেভেনের দুজনকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর এল এ রকম, ‘স্যার, অ্যাট ফার্স্ট হি কিলড (পিঠের ওপর কিল) মি দেন আই কিলড হিম।’
আমাদের একজন অপ্রাসঙ্গিক স্টাফ ছিলেন। তার অপ্রাসঙ্গিকতার নমুনা শুনুন,
ম্যাট্রিক পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে আমাদের এক বন্ধু তার কাছে—
: স্টাফ, দোয়া কইরেন।
: আরে, ভয়ের কী আছে? গতকাল যে চিটাগাং থেকে বরিশাল আসলাম, আমি কি ভয় পাইছি?
আহমেদ রায়হান
বরিশাল ক্যাডেট কলেজ [১৯৯৯-২০০৫]
ইংরেজির এক স্যার একদিন খুব রেগে গেলেন। আমার ক্লাসমেট শাহরিয়ার গান গাইতে গাইতে গোসল করছিল, হাউস অফিসের সবচেয়ে কাছের বাথরুমটিতে। স্যার ছিলেন ডিউটি মাস্টার। হঠাত্ শুনলেন, বাথরুমে কে যেন জোরে জোরে গান গাইছে। ‘পিয়া তু আব তো আ যা…মনিকা ও মাই ডারলিং… মনিকা ও মাই ডারলিং।’ স্যার দাঁড়িয়ে থাকলেন, বাথরুম থেকে কে বের হয় দেখার জন্য। শাহরিয়ার বের হলো। তোয়ালে পরা অবস্থায় হাউস অফিসের সামনে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন অনেকক্ষণ।
স্যারের কী দোষ, স্যার তো আর জানতেন না সিনেমায় নায়িকার নামই মনিকা।
শাহরিয়ারেরই বা কী দোষ। ও তো আর জানত না স্যারের মেয়ের নাম মনিকা।
কামরুল হাসান, সিলেট ক্যাডেট কলেজ [১৯৯৪-২০০০]
চারুকলার স্যার যখন প্রথম আমাদের কলেজে জয়েন করেন, তখন তিনি বেশ গাট্টাগোট্টা, ছোটখাটো টাইপের মানুষ। হঠাত্ দেখলে তাঁকে স্যার বলে মনে হতো না। কেমন ক্লাস টুয়েলভ ক্লাস টুয়েলভ মনে হতো। স্যার ছিলেন তিতুমীর হাউসের সঙ্গে এটাচড এবং গণহারে সবাইকে তুই করে বলতেন।
সেবার ইন্টার হাউস ফুটবলের আগে আমাদের অল্টারনেটিভ জুনিয়র ব্যাচের একজন (ওরা তখন মাত্র কলেজে এসেছে, ক্লাস সেভেন) তার গাইডকে জিজ্ঞেস করল,
—ভাইয়া, আমি যদি হাউস টিমে ফুটবল খেলতে চাই, তাইলে কী করতে হবে?
—ওই যে কোনায় হাউস প্রিফেক্টের রুম আছে। তার কাছে গিয়া বলবা, ভাইয়া, আমি ফুটবল ভালো খেলি, হাউস টিমে খেলতে চাই।
—ভাইয়া, আমি তো হাউস প্রিফেক্টকে চিনি না।
—আরে, দেখবা একটু ছোটখাটো, মোটাসোটা একজন ভাইয়া আছেন। তিনিই হাউস প্রিফেক্ট। তাঁকে বললেই হবে।
সে জুনিয়র হাউস প্রিফেক্টের রুমের সামনে গেল। ঘটনাক্রমে ওইখানে তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন চারুকলার স্যার। সাইজ দেখে সে ভাবল, এটাই হাউস প্রিফেক্ট।
—স্লামালিকুম, ভাইয়া।
—কী? স্যার আঁতকে উঠলেন, তাঁকে কেউ ভাইয়া বলছে এটা শুনে।
—ভাইয়া, আমি খুব ভালো ফুটবল খেলি। হাউস টিমে জুনিয়র গ্রুপে খেলতে চাই।
—এই, তুই হ্যান্ডস ডাউন হ। ব্যান্ড হ। ব্যান্ড হ বলতেছি। স্যারের রাগ তখন দেখে কে।
আচমকা এ রকম আক্রমণে ওই জুনিয়রও দিশেহারা হয়ে গেল। সে হ্যান্ডস ডাউন হলো এবং কিছু না বুঝে বলল,
—সরি, ভাইয়া।
—আবার ভাইয়া বলে…
এবার ওই জুনিয়র ভাবল, হাউস প্রিফেক্টদের বোধ হয় ভাইয়া বলার নিয়ম নেই। সে অন্যভাবে ট্রাই করল।
—সরি, প্রিফেক্ট। আমার ভুল হয়ে গেছে প্রিফেক্ট। আমি আসলে হাউস টিমে খেলতে চাই, এটা বলতে এসেছিলাম।
—কী কইলি তুই? আমি প্রিফেক্ট। দাঁড়া… এই বাবুলাল বেত বের কর।
বাবুলাল আমাদের হাউস বেয়ারার নাম।
এরপর ওই বেচারার কী হয়েছিল আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন। হাউস টিমে খেলার শখ তার সেই দিনই চলে গিয়েছিল।
কামরুল হাসান
সিলেট ক্যাডেট কলেজ [১৯৯৪-২০০০]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৮, ২০১০
Leave a Reply