বাসররাতেই নাকি বেড়াল মারতে হয়। কিন্তু আমাদের দেবা তার জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে মেরেছিল মশা!
তখন মাঝরাত। কবিগোত্রের কাছে অতি প্রিয় সময়। এ সময়ই নাকি কাব্যদেবীর আরাধনা করতে হয়। আমাদের দেবা, এককালের স্বঘোষিত দেবদাসও করেছে। সেই দেবার কাছেই আজ কাব্যদেবীটেবি কেউ কল্কে পাচ্ছে না। আজ তার আরাধনা কেবল একজন দেবীর উদ্দেশেই। শুভলগ্নে ‘যদি দং হূদয়ং মম’ বলে যার সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েছে সে। সাড়ম্বরে গলায় গামছা বেঁধে ব্যাচেলর ডিগ্রির বিসর্জন।
ভাবলাম, বন্ধুবর (পরে অবশ্য বুঝেছি, বর কখনো বন্ধু হয় না। সে কাহিনি খানিক পরে হবে) কী করছে একটু খতিয়ে দেখা দরকার। দেবা কি আহত? নাকি মর্মাহত? ‘কাছে থাকুন’ স্লোগানে উদ্দীপিত আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম দেবার মোবাইল ফোনে। দেবাকে রসিক বলতেই হবে। ওয়েলকাম টিউনে বাজছে, ‘এই রাত তোমার আমার, শুধু দুজনে…!’
শুধু দুজনে মানে? আমরা বাকিরা তাহলে ফেউ! ইচ্ছে করছিল দেবাকে কষে একটা চড় লাগাই। অদৃষ্টের কী পরিহাস দেখুন, দেবা ফোন রিসিভ করতেই ওই প্রান্ত থেকে ঠাস করে একটা শব্দ এল। খানিক পরেই দেবার চাপা আর্তনাদ! সেকি! বিয়ের আসরে কাতান শাড়ি কিংবা লজ্জার ভারে অবনত দেখে এসেছি যে কিশোরীবধূকে, সে-ই কি তবে বিয়ের প্রথম দিনেই (মানে রাতে আরকি) স্বরূপে আবির্ভূত!
হতেও পারে। ‘ছলনাময়ী’ শব্দটা এত দিন ছাপার অক্ষরে পড়ে এসেছে দেবা। আজ বুঝি চলছে তার হাতে-কলমে শিক্ষা। খোদ গুরুদেব পর্যন্ত ঠাওরে যেতে পারেননি নারীর অপার রহস্য। ছলনার শিকার হয়ে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, ‘যত পাই তোমায় আরও তত যাচি, যত জানি তত জানিনে!’
ভাবনায় ছেদ ঘটল আরেকটি ঠাস এবং দেবার মৃদু আর্তনাদে। ‘কী হলো, কী হলো?’ ‘আর বলিস না, ঘরভর্তি মশা! মশারি টানানোর ব্যবস্থা নেই। কয়েলও দিয়ে যায়নি। মশার যন্ত্রণায় আর টিকতে পারতেছি না রে দোস্ত!’ দেবার করুণ আর্তিতে বিচলিত হওয়ার চেয়ে আমরা বরং খুশিই হই। উচিত শিক্ষা হয়েছে! ব্যাটা ফাজিল। বিয়ের আসরে আমাদের তো পাত্তাই দিলি না। তোর জন্য কত কষ্ট করে সেই সুদূর ঢাকা থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলাম আমরা। পথে পথে সেতুর টোল দিতে দিতে আমাদের ফতুর হওয়ার দশা। কেউ একজন তো হিসাব কষে বের করল, যতবার টোল দিয়েছি, সেই টাকায় নাকি প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর বাজেট উঠে যাওয়ার কথা। একবার তো এমনও হলো, টোল দিলাম ঠিকই, কিন্তু সেতুর ‘স’ও চোখে পড়ল না। কেন টোল নিল কে জানে!
সেই আমরা ভ্রমণক্লান্তি হাসিমুখে ভুলে ঢুকেছিলাম বিয়েবাড়িতে। গিয়ে দেখি মাথায় ইয়া বড় একটা টোপর পরে বরের মঞ্চে বসে দেবা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। হাতে চকচকে সোনালি ঘড়ি! আমাদের লোলুপ ও সন্দিগ্ধ চাহনি দেখে স্বীকারোক্তির ঢঙে দেবাই বলে উঠল, ‘কসম, শ্বশুরবাড়ি থেকে শুধু এই ঘড়িটাই নিছি, আর কিছু না। বিশ্বাস কর।’ চোরের মন পুলিশ পুলিশ!
প্রথম দিকে ঠিকই ছিল। কিন্তু যেই বিয়ের মণ্ডপে নববধূকে পাশে পেল, বন্ধুদের কথা যেন বেমালুম ভুলে গেল বন্ধুবর! সে যা-ই হোক, পুরুতঠাকুর মন্ত্র আওড়ে যাচ্ছেন। সংস্কৃত বড় খটমটে। কিছু কিছু শব্দ অবশ্য পরিচিতই। বিশেষ করে কানে খট করে লাগল ‘ভক্ষণং’ শব্দটা। চট করে মনে পড়ে গেল, ঢাকার এক লোকাল বাসের গায়ে লেখা দেখেছি সামনের তিনটা সিট ‘মহিলা ও পতিবন্দীদের জন্য সংরক্ষিত’। ‘পতি’ মাত্রই যে ‘বন্দী’, এই তথ্য দেখি সমাজের সব স্তরেই!
পুরুতঠাকুরকে দেখে মনে পড়ে গেল ধন্যি মেয়ে-এর রবি ঘোষের কথা। গাঁয়ের ঠাকুর রবি ঘোষ বড় তোতলান। সংস্কৃত তো দূরের কথা, সোজা বাংলা বলতেই জিভে ঠোকাঠুকি। কেউ একজন বুদ্ধি করে শহর থেকে গ্রামোফোনের রেকর্ড করা মন্ত্র নিয়ে এসেছিল। শ্রাদ্ধ থেকে শুরু করে বিয়ে, অন্নপ্রাসনের হরেক রেকর্ড। তারই একটা বাজছে। রবি ঘোষ কেবল ঠোঁট মিলিয়ে যাচ্ছেন। বিয়ের মাঝপথে হইহই করে উঠলেন কেউ একজন, ‘সেকি! এ যে বিয়ের বদলে বাজছে শ্রাদ্ধের রেকর্ড!’ এত দিন পর বুঝলাম, ওই ছবির পরিচালক কী বোঝাতে চেয়েছেন। বিয়ে তো এক ধরনের শ্রাদ্ধই! ওই যে, পুরুষ মানুষ দুই প্রকার—জীবিত ও বিবাহিত!
দেবার বিয়ে চলার সময় অবশ্য তেমন অঘটন ঘটেনি। ঘটেছিল শুরুতে। পাত্রীকে মণ্ডপে বসানো হয়েছে। দেবাকেও কেউ একজন ডাক দিল। অমনি হনহন করে হাঁটা দিল সে। যেন বিয়ে করতে তর সইছে না তার! গুরুজনদের একজন ধমকেই দিলেন, ‘অভিভাবক কারও অনুমতি নিলে না যে!’ অতঃপর দেবা অনুমতি নিল তার কাকার কাছ থেকে, ‘কাকা, যাচ্ছি।’ হাত তুলে কাকা আশীর্বাদ করলেন, ‘যাও, বাবা।’ যেন বিয়ে নয়, দেবা যাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা দিতে!
দেবা আসলেই সত্যিকারের পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিল বাসররাতে। বাকি আত্মীয়স্বজন দরজায় খিল এঁটে দিয়ে চলে গেছে ঘরের বাইরে। কিন্তু মশককুলকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না, এই দুই মানব-মানবীর আজ একা থাকা খুবই প্রয়োজন। মশারা তো বড্ড বেরসিক। দৃশ্যটা কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয়নি: মাথায় ঘোমটা টেনে ফুলশয্যায় বসে আছে নববধূ। আর দেবা ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটছে মশার পেছনে। দেবার বাসরঘরে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচিয়ে থাকা একটা পোস্টারও দেখে এসেছিলাম। সেই পোস্টারে বড় হরফে লেখা বাক্যটা বড় সার্থক মনে হলো: রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০১, ২০১০
Leave a Reply