একটা গল্প বলি। ভালো গল্প। ভদ্রলোকের গল্প। আমি যে আপনাদের গল্প বলছি সেটা কিন্তু সবাইকে জানানো চলবে না। আমার পরিচিতজনেরা রে রে করে তেড়ে আসতে পারে। তাদের তেড়ে আসাটা দোষের কিছু না। বিশেষ করে যারা আমাকে চেনে। তা ছাড়া রস+আলো পরিবারের ছোট-বড় সবাই পড়ে। সম্পাদকও বলে দিয়েছেন, একটা ভালো গল্প এখানে বলতে হবে, ভদ্রলোকদের গল্প। খারাপ কিছু চলবে না।
আমি নিশ্চিত, আমার পরিচিত যে কেউই থাকলে বলত, তুমি মিয়া লিখবা ভদ্রলোকের গল্প। শুরু করলেও পরে ঠিকই অন্য লাইনে চলে যাবা।
এ ধারণা কিন্তু ঠিক না। আমি মোটেই সে রকম না। প্রমাণ আজই হয়ে যাবে। এই লেখাটা ছাপা হলে আমি নিশ্চিত যে আমার সম্বন্ধে পরিচিতজনদের ধারণা পুরোটাই পাল্টে যাবে। বড়দের গল্প বলিয়ে হিসেবে আমার বদনাম কেটে যাবে।
গল্পটাই না হয় শুরু করি। এটা আসলে একটা বিয়ের গল্প। বিয়ের গল্প মানে সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর গল্প। এক লোক বিয়ে করছে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বউকে নিয়ে আসছে বাসায়। রাত বাড়ল। সবাই তাকে ঠেলেঠুলে বাসরঘরে ঢুকিয়ে দিল।
এটুকু শুনেই যাদের চোখ চকচক করে উঠছে তাদের বলি, এটা কিন্তু ভদ্রলোকের গল্প। এখানে লাইনমতোই গল্প থাকবে। অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগই নেই।
গল্পটা শেষ করি তাহলে। বাসরঘরে নতুন বউ বসে আছে। ঘরময় ফুল, আর তার মধ্যে পার্লার-ফেরত ফুলের মতো বউ। ছেলেটা শুরুতেই জরুরি কাজটা করল, মানে দরজাটা বন্ধ করল আরকি। মাথার পাগড়িটা খুলল। তারপর এগিয়ে গেল নতুন বউয়ের দিকে।
পরিচিত বা বন্ধুবান্ধব কেউ পাশে থাকলে আমাকে এখানেই থামিয়ে দিয়ে বলত, ভাই রে আর আগাইয়ো না। এইবার থামো। তোমাকে আমরা চিনি। তুমি এইবার অন্য লাইনে যাইবা। এখানে কিন্তু ছোট-বড় নানা ধরনের পাঠক থাকে। রস+আলো একটা পারিবারিক ফান ম্যাগাজিন।
—আরে না। এইটা তো ভালো গল্প, ভদ্রলোকের গল্প। এখানে খারাপ কিছু নাই। শোনেন আগে।
তারপর ছেলেটা গেল নববধূর কাছে। ঘোমটা খুলে নতুন বউকে মন ভরে খানিকক্ষণ দেখল। বউয়ের হাতটাও একবার ধরল। তারপর…।
কারও কি মনে হচ্ছে, এবার আমার থামা দরকার? গল্প অন্যদিকে চলে যাচ্ছে? চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটা ভদ্রলোকের গল্প। আমি তো আগেই বলেছি। সবটা শোনেন সবাই আগে।
তারপর ছেলেটা তার নতুন বউকে হাত ধরে ওঠাল। বাইরে উথালপাথাল জোছনা। চাঁদের আলোয় ভরে আছে চারদিক। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট একটা বারান্দা। ছেলেটা কিন্তু নতুন বউকে নিয়ে সেদিকে গেল না। তাহলে কই গেল? ছেলেটা নতুন বউকে নিয়ে গেল বাথরুমে।
আরে দূর, চিন্তা করবেন না। উসখুস করার কিছু নেই। অন্য কিছু না। বলছি না এটা ভদ্রলোকের গল্প?
তারপর তারা বাথরুমে গিয়ে অজু করল। ঘরে ফিরে দুজনই পড়ল দুই রাকাত নফল নামাজ। অনেক ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে তারা অবশেষে বিয়ে করতে পেরেছে। নফল নামাজ তো পড়াই উচিত। আবার মুরব্বিরাও তো বলে দিয়েছে।
তারপর আবার তারা গেল বিছানার দিকে। আমাদের গল্পের ছেলেটা হয় অতি সাবধানী না হয় খানিকটা কৃপণ। আবার কেউ কেউ তাকে বুদ্ধিমানও বলতে পারেন। কেননা সে বলল, শেরওয়ানি পরে থাকতে তার আর ভালো লাগছে না, আর নতুন বউয়েরও উচিত শাড়িটা খুলে রাখা। তা না হলে দামি শাড়িটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, শেরওয়ানিটা ভাড়ায় আনা। নষ্ট হলে ফেরত না-ও নিতে পারে।
আরে আরে, এটুকু পড়েই চলে যাবেন না যেন। শাড়ি খুলছে তো কী হয়েছে। বলছি না এটা ভদ্রলোকের গল্প? এখানে খারাপ কিছু নেই।
তারপর?
তারপর আর কী? দুই দিন ধরে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। তারপর সারা দিনের বিয়ের ধকল। দুজনই পরিশ্রান্ত। কাপড় পাল্টে তারা শুয়ে পড়ল। দুজনেরই ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগল না।
তারপর?
তারপর সকালে উঠল, নাশতা করল, আত্মীয়স্বজন তো ছিলই। বন্ধুরাও এল আড্ডা দিতে। এই তো।
পাঠক-পাঠিকার কেউ পাশে থাকলে ধমক দিয়ে বলত, দূর মিয়া, এটা কোনো গল্প হলো? কিছুই তো নেই!
তাহলে শোনেন সবাই, ভদ্রলোকের গল্প এ রকমই হয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০১, ২০১০
Leave a Reply