স্কুল-কলেজে গল্প-উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা পড়ানো হয়। প্রশ্নও আসে—পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটির নামকরণ কতটুকু সার্থক হয়েছে, আদৌ সার্থক হয়েছে কি না…এসব হাবিজাবি। আরে ভাই, লেখক বহুকষ্টে একটা উপন্যাস লিখে কোনোমতে একটা নাম দিয়েছে, সেই নাম নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? উপন্যাস ভালো লাগলে ভালো, হাততালি দেন। আর না লাগলে নাই। নামকরণ সার্থক হয়েছে কি না তা নিয়ে পেরেশান হয়ে লাভ আছে? চাইলেও তো এফিডেবিট করে নাম বদলানো যাবে না। আসলে আমাদের দেশের শিক্ষকেরা এ রকমই। যে জিনিস কখনোই পারবেন না তা নিয়ে লাফালাফি। এ ধরনের শিক্ষকদের দিয়ে কিছু হবে বলে মনে হয় না। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী কত্ত ভালো। কী সুন্দরভাবে বিমানবন্দর, সম্মেলনকেন্দ্র, সড়ক, গলি-উপগলি ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানের নাম বদলে নামকরণের সার্থকতা বিষয়টা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষাটা না নিয়ে সবাই উল্টাপাল্টা কথা বলছে। এটা তো ঠিক না। দেশের প্রধান বিমানবন্দরের নাম বদলে ফেলা হয়েছে, তাতে হয়েছেটা কী? নাম তো বদলাতেই হবে। একটা দেশের বিমানবন্দর সারা জীবন এক নামে থাকবে, এটা কেমন কথা? সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ইংল্যান্ডের বিমানবন্দরের নাম হিথরো। এত বছর হয়ে গেল, কেউ ওই নামটা পরিবর্তন করল না। এটা কোনো কথা হলো? আমাদের সরকারের মতো ক্রিয়েটিভ হলে অনেক আগেই নাম বদলে দিত। নতুনত্ব বলে একটা কথা আছে না? যেখানে কবি নিজের মুখে নতুনের জয়গান গাইতে বলেছেন, সেখানে পুরোনো জিনিস নিয়ে পড়ে থাকার মানে হলো স্বয়ং কবির কথা অবজ্ঞা করা। কবিরা দারুণ ইমোশনাল। তাদের অবজ্ঞা করলে তারা মাইন্ড করতে পারে। আর যে দেশে কবির কদর হয় না সে দেশ কোনো দিন উন্নতি করবে না, এটা তো জানা কথা। আমাদের সরকার এটা খুব ভালো করে জানে। তা ছাড়া, আমাদের দেশে কি নাম কম আছে? বাংলাভাষায় বর্ণ বেশি, নামও বেশি। দরকার হলে প্রতি মাসে নাম বদলানো হবে। তাতে কার কী? অন্য সময় তো ঠিকই বলে, নামে কী-বা আসে যায়? নাম দিয়া কাম কী? তাহলে এখন নাম নিয়ে এত ঘটনা কেন? আমাদের সরকারগুলো সাধারণ মানুষকে নিয়ে কতটা চিন্তাভাবনা করে তা তো এই নামকরণ দেখলেই বোঝা যায়। প্রতিটি দেশের নাগরিকদের জন্য ‘সাধারণ জ্ঞান’ খুবই জরুরি। চাকরির ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে বিয়ে—সব জায়গাতেই সাধারণ জ্ঞানের দরকার আছে। নেপোলিয়ন কে ছিলেন? গান্ধী প্যান্ট পরতেন নাকি ধুতি? অমুক দেশের রাজধানী, মুদ্রা, বিমানবন্দরের নাম কী—এগুলো সবারই জানা দরকার এবং এসব তথ্য প্রতিনিয়ত আপগ্রেড করা উচিত। আমাদের সরকারও সেটাই করছে। তাই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জিনিসের নাম পরিবর্তন করে সবাইকে রাখছে একেবারে দৌড়ের ওপর। এখন সবাইকে মনে রাখতে হচ্ছে, বাংলাদেশে বিমানবন্দরের বর্তমান নাম কী? আগের নাম কী ছিল? কবে পরিবর্তন করা হলো?…আরও কত কিছু! এতে দেশের মানুষের তথ্য ধারণক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে, বাড়বে সাধারণ জ্ঞান। ছাত্ররা সব বিষয়ে ফেল করলেও সাধারণ জ্ঞানে এ প্লাস পেয়ে বলবে,
—মা, মা, বড় হয়ে আমি জেনারেল হব।
—সব বিষয়ে ফেল মেরে বসে আছিস, তুই তো আর্মিতেই চান্স পাবি না, জেনারেল হবি কীভাবে?
—কী যে বলো, আমি জেনারেল নলেজে এ প্লাস পেয়েছি তো!
তাই, সঠিক তথ্য জানা খুবই দরকার। তা না হলে ভেজাল হতে পারে। কদিন আগে পৃথিবীর বাইরে ভিনগ্রহের এক এলিয়েনও এই ভেজালে পড়েছে। তাকে বিভিন্ন তথ্য নিতে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে। সে তো মহা খুশি, ছোট্ট একটা দেশ, এর আর কী তথ্য? সে হেসেখেলে তথ্য সংগ্রহ করে ওপরমহলের কাছে রিপোর্ট জমা দিল। ভিনগ্রহের ওপরমহল তো আর আমাদের ওপরমহলের মতো না যে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে! তারা রিপোর্ট নিয়ে আরও গবেষণার জন্য আরেকজন এলিয়েনকে পাঠাল। সেই এলিয়েন এসে দেখে, যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তার সবই ভুল। যার ফলে আগের নিরীহ এলিয়েনটাকে জেলে যেতে হলো। এখন সে আক্ষেপ করে পাশের কয়েদি এলিয়েনকে বলে, ‘বুঝলেন ভাই, পৃথিবীতে দেশও আছে একটা, বাংলাদেশ নাম। মারাত্মক অ্যাডভান্স। কীভাবে যেন টের পেয়েছে যে আমি ওদের দেশের তথ্য নিয়েছি, ব্যস! একেবারে সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দর, নভোথিয়েটার, সম্মেলন কেন্দ্র, রাস্তা সবকিছুর নাম বদলে ফেলেছে। এদের কাছে আমাদের গ্রহ তো কিছুই না। জানতে পারলে এরা আমাদের গ্রহের নামও দুই মিনিটে বদলে ফেলতে পারে। এদের অনেক ক্ষমতা।’
ভিনগ্রহের এলিয়েন এই ক্ষমতা বুঝলেও আমরা বুঝতে পারছি না। অথচ ছোটবেলায় সবাই পড়েছি, বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়! মানে হলো, নাম কোনো ব্যাপারই না। ছোটবেলার সেই পড়াই যদি মনে না রাখি তাহলে পড়ালেখা করে কী লাভ হলো? আমাদের উচিত ছোটবেলার সেই পড়া মনে রাখা। বিমানবন্দরের নাম যাই হোক, প্লেন ওঠানামা করলেই হলো। তবে যেহেতু সবকিছু বদলে যাচ্ছে, তাই প্রশ্নটাও একটু বদলে দিলে ভালো হয়। এখন সবার বলা উচিত—বিমানবন্দর তোমার নাম কী? …পরিচয় (বুদ্ধিমানেরা বুঝে নিন)!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০১, ২০১০
Leave a Reply