মফস্বল শহরে একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছে ম্যাজিক দেখাতে আর সেই ম্যাজিক প্রদর্শনীর দ্বারোদ্ঘাটন করতে হবে একজন সাহিত্যিককে।
অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্য। আর তা সেদিন ঘটে গেল আমারই জীবনে।
কী করব? ‘মায়া ও মায়াবী’ কোম্পানির স্বয়ং ম্যাজিশিয়ান বাড়ি এসে অনুরোধ করে গেলেন। তাই কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। তিনি আবার নিজে থেকেই আমার উদ্বোধনী বক্তৃতার বিষয়বস্তুও বলে দিয়ে গেলেন। না, জাদুবিদ্যাটিদ্যা নিয়ে না, স্রেফ ম্যাজিক নিয়ে আমার ছেলেবেলার কোনো স্মরণীয় ঘটনা। আমি নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। এটা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। ম্যাজিক নিয়ে ছোটবেলার একটা ঘটনার খেই ধরে টান দিলেই বক্তৃতা জমে উঠবে।
হলে দর্শক গিজগিজ করছে। মাইকের সামনে মাল্যভূষিত আমি দাঁড়িয়ে। কী বলব, মোটামুটি তাও ঠিক করে ফেলেছি। নির্দেশ পাওয়া মাত্র বলতে শুরু করলাম, ছোটবেলায় একবার ম্যাজিশিয়ান হওয়ার শখ হয়েছিল। ছোটদের পত্রিকায় তখন ছবিটবি দিয়ে ম্যাজিক শেখানো হতো। সেগুলো গোগ্রাসে গিলতাম, বাড়িতেও প্র্যাকটিস করতাম। তখন বয়স তেরো-চৌদ্দ। পত্রিকা আর ম্যাজিকের বই পড়ে বেশ কয়েক রকম ম্যাজিক শিখে ফেলেছিলাম, বিশেষ করে তাসের ম্যাজিক। আমার সঙ্গী ছিল আমার প্রায় সমবয়সী বোন গীতা। বিদ্যে যখন বেশ কিছুটা আয়ত্ত হয়েছে তখন একদিন গীতার পরামর্শে বাড়ির বৈঠকখানায় ম্যাজিক দেখানোর ঘোষণা হলো। গীতা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাড়ার যত ছোট ছেলেমেয়েদের নেমন্তন্ন করে এল। নেমন্তন্ন পর্ব শেষে গীতা বলল, সবাইকে নেমন্তন্ন করা হলো, শুধু মন্টিকেই বলা হলো না। মন্টির নাম শুনেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল। বললাম, ওকে বলতে হবে না। গীতা ইতস্তত করে বলল, তবু, পাড়ার মেয়ে তো। বললাম, তা হোক। ও এলে সব ভেস্তে দেবে। মন্টির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। বয়েস তার বছর এগারো। পাতলা, রোগা। ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুল। গোল মুখ। দু চোখে সব সময় দুষ্টুমি বুদ্ধি ছটফট করছে। আর আমার কোনো ভালো কাজ যেন সহ্য করতে পারত না। ভালো কাজ মানে, হয়তো সেবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে উঠেছি। ও এসে আমাকে শুনিয়েই বলল, এবার কোশ্চেন এত সোজা পড়েছিল যে গাধাগুলোকে পরীক্ষা দেওয়ালে তারাও ফার্স্ট হতে পারত।
একদিন শুয়ে শুয়ে একমনে শিশু-সাথী থেকে ম্যাজিকের ফর্মুলা টুকে নিচ্ছি, হঠাত্ ও ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে ছোঁ মেরে পত্রিকাটা কেড়ে নিল।
ও, ম্যাজিক শেখা হচ্ছে? ম্যাজিশিয়ান হবেন! কচু—কচু হবে। বলে বুড়ো আঙুল দুটো দেখিয়ে পত্রিকাটা নিয়ে ছুটে পালাল! অনেক চেষ্টা করে পত্রিকাটি উদ্ধার করলাম। কিন্তু হায়, ম্যাজিকের পাতা কটাই নেই। কাজেই এমন মেয়েকে আমার ম্যাজিক প্রদর্শনীর শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন করতে এতটুকু ইচ্ছে হয়নি। এই পর্যন্ত বলে আমি যখন একটু হেসেছিলাম, দর্শকমণ্ডলী তখন সম্মিলিত হর্ষধ্বনি দিয়ে আমায় উত্সাহিত করলেন, তারপর?
সন্ধ্যায় ম্যাজিক। সারা দুপুর আমরা ভাইবোনে প্রস্তুতি নিলাম। মাঝের ছোট ঘরটিকে গ্রিনরুম বানিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো কালো পর্দা।
সন্ধে হতেই ছেলেমেয়ের ভিড়ে বৈঠকখানা ভরে গেল। হাফপ্যান্ট আর হাফহাতা শার্ট পরে তো ম্যাজিক দেখানো যায় না। কিন্তু সে পোশাক কোথায় পাব? শেষে গীতাই এনে দিল দাদুর সাদা ঢোলা প্যান্ট। সেটাই পরলাম কোমরে কষে দঁড়ি এঁটে। দাদু ছিলেন উকিল। গায়ে চড়ালাম তাঁর চোগা-চাপকান। সে এক অদ্ভুত ড্রেস। একটা কালো টুপি না হলে ম্যাজিশিয়ান বলে মানাবে না। টুপিও জুটে গেল। আমাদের পাড়ার এক খ্রিষ্টান ডাক্তারের একটা হ্যাট চেয়ে আনা হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম ফার্স্ট ক্লাস মানিয়েছে। একটাই শুধু অসুবিধে, প্যান্টটা বড়ই ঢিলে আর বড়। তাসের ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে যদি বারে বারে প্যান্ট সামলাতে হয়, তাহলেই চিত্তির!
যা-ই হোক, যথাসময়ে ঘণ্টার অভাবে কাঁসার থালা বাজিয়ে ম্যাজিক শুরু করা হলো। আমি একটার পর একটা তাসের খেলা দেখিয়ে গেলাম। হাত তালি পড়ছে চটাপট চটাপট।
এবার থট রিডিংয়ের খেলা। বোর্ডে একজন খড়ি দিয়ে কয়েকটা অঙ্ক লিখবে, আমি চোখ বাঁধা অবস্থায় তা বলে যাব। কথাটা ঘোষণা মাত্র দর্শকেরা মেরুদণ্ড টান টান করে বসল। একজন এসে রুমাল দিয়ে আমার চোখ এমন কষে বেঁধে দিল যে মনে হলো মণি দুটো বুঝি গলেই গেল। যা হোক, ওই কষ্টটুকু ম্যাজিশিয়ানকে সহ্য করতেই হয়। আমিও করলাম।
এদিকে একজন খড়ি হাতে উঠে গিয়েছে অঙ্ক লিখতে। ব্ল্যাকবোর্ড নেই। না থাক, জানালার চওড়া কপাট তো আছে। সেখানে খড়ি দিয়ে একটা ছোটখাটো অঙ্ক লেখা হলো। আমি তো অন্ধ। বুক ধুকধুক করছে। সবটাই নির্ভর করছে গীতার ওপর। প্যান্টের নিচে পায়ের গোড়ালিতে দড়ি বাঁধা। আমি সেই অবস্থায় বাইরে দাঁড়িয়ে। গীতা পর্দার আড়ালে গ্রিনরুমে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে দড়ি ধরে আছে। পর্দা সরিয়ে একবার করে একটা অঙ্ক দেখছে আর গুনে গুনে পায়ে দড়ির টান দিচ্ছে। আমিও কটা টান হিসাব করে হাঁকছি—চার, সাত, নয়।
একবার খেলার মধ্যেই পর্দার আড়াল থেকে গীতার চাপা গর্জন শোনা গেল, এই ফুলি, বোস! প্রথমটা বুঝিনি, পরে বুঝলাম ফুলি বলে মেয়েটি হঠাত্ উঠে দাঁড়ানোয় গীতা অঙ্কটা দেখতে পাচ্ছিল না।
যা-ই হোক, খেলাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, হঠাত্ দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে চাঞ্চল্য। কে একজন বাইরে থেকে মত্ত মাতঙ্গিনীর মতো ভেতরে ঢুকে একে মাড়িয়ে, ওকে ডিঙিয়ে গ্রিনরুমের দিকে ধেয়ে আসছে…
—দাদা রে, মন্টি! গীতা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
আমার চোখ বাঁধা। কিছুই বুঝতে পারছি না। শেষে চোখের বাঁধন খুলে ফেললাম। দেখলাম মন্টি গ্রিনরুমে ঢুকেছে। রাগে দিশেহারা হয়ে মন্টির কান ধরে টেনে বের করে দিলাম। কিন্তু মন্টি ততক্ষণে আমার যা সর্বনাশ করার করে দিয়েছে। গীতার হাত থেকে দড়িটা টেনে নিয়ে দর্শককে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। দড়ির অন্য প্রান্ত তখনো আমার পায়ে বাঁধা।
খুদে দর্শকমণ্ডলী তখনই হাসতে হাসতে হই হই করে উঠে চলে গেল।
এই লজ্জাকর ঘটনার পর আর কোনো দিন ম্যাজিক দেখাইনি। মন্টিরও খোঁজ রাখিনি, রাখতে প্রবৃত্তি হয়নি। তারপর একদিন মন্টিরা কেন বাইরে চলে গেল তাও জানি না।
ভাষণ শেষ হতেই হলঘর হাততালিতে ভরে গেল।
পর্দার অন্তরাল থেকে অ্যানাউন্স করা হলো, এবার আজকের ম্যাজিশিয়ানের পত্নী সভাপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন।
ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই লালপাড় গরদের শাড়ি, লাল ব্লাউজ গায়ে ম্যাজিশিয়ানের স্ত্রী হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম পরস্ত্রী, শুধু পরস্ত্রী কেন, কোনো মহিলার দিকে অমন হাঁ করে চেয়ে থাকাটা ভদ্রতাবিরুদ্ধ।
ম্যাজিশিয়ানের স্ত্রী গদগদ ভাষায় সভাপতিকে তাঁর প্রাপ্যের চেয়ে ঢের বেশি প্রশংসা আর শ্রদ্ধা উপহার দিয়ে বললেন, মাননীয় সভাপতি মহাশয় তাঁর বাল্যজীবনে একদিন ম্যাজিশিয়ান হওয়ার শখের কথা বিস্তৃতভাবে শোনালেন। মন্টি নামের যে মেয়েটা সেদিন তাঁকে উত্ত্যক্ত করে তুলেছিল, তিনি যে তাকে আজও ভোলেননি এটা বিশেষ করে আমার পরম সৌভাগ্য। আজ বহুকাল পরে পার্টি নিয়ে দেশে এসেছি শুধু এঁকে দেখাতে। তিনি দয়া করে সেই মন্টিকে ক্ষমা করুন।
বলে ম্যাজিশিয়ানের অভিজাত স্ত্রী-রত্নটি ভূমিষ্ঠ হয়ে আমায় প্রণাম করল।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
মাইকে ঘোষণা করা হলো—‘মায়া ও মায়াবী কোম্পানির জাদু প্রদর্শনীর প্রথম দিনের খেলার প্রথম আইটেম “ক্ষমা প্রার্থনা” দেখানো হলো। এবার দ্বিতীয় আইটেম—’
মানবেন্দ্র পাল: ভারতীয় লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০১, ২০১০
Leave a Reply