লেখাটা কি অশিষ্টতা, অশ্লীলতার কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করব? জানি, অনেকের লোভ হচ্ছে! তাঁদের জন্য পরামর্শ—সংসদ অধিবেশনে কান রাখুন। খিস্তিখেউড়সহ পাবেন এক চ্যানেলে! আরেকটি সুখবর, শুধু সংসদ অধিবেশন প্রচার করতে বিটিভির শাখা চ্যানেল করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। আশা করি, ভরপুর বিনোদন পাওয়া যাবে।
কিন্তু যাঁরা এসব দেখতে-শুনতে চান না, তাঁদের কী হবে? কান বন্ধ করে তো আর চলা যাবে না। চোখ বন্ধ করেও থাকা যাবে না। তাই ‘বাঁচতে হলে ভাবতে হবে’। অশ্লীলতার সংক্রমণ তো এইডসের চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়।
কী করা যায়! বাংলা ভাষায় সহজলভ্য সব অশ্রাব্য কথা তো আমরা ছোটবেলায়ই শিখে ফেলি। আর নিজেদের মধ্য থেকে কিছু লোককেই তো আমরা সংসদে পাঠাই। ফলে সাংসদদের ওসব ভালোই জানা এবং প্রায়ই তাঁরা তার অনুশীলন করেন। নিজের ভাষায় বলেন বলে তাঁরা বকাবাদ্যে বাড়তি জোশও পান। এ জোশটা কমাতে পারলেই রোষ কমতে শুরু করবে। কিন্তু ভাষার মাস বলে প্রস্তাবটা দিতে সংকোচ হচ্ছে। তবু সাহস করে বলি, সারা বছর তো আর ফেব্রুয়ারি মাস থাকবে না!
আইডিয়াটা পরিষ্কার করি। আচ্ছা! রাজনীতিবিদদের কথা বলার ভাষাটা যদি বদলে দেওয়া যায়! তাহলে কি ফল লাভ হবে? বক্তৃতার ভাষা হিন্দি হলে কেমন হয়? প্রতিবেশী রাষ্ট্র বলে প্রথমে হিন্দির কথা বলা। পেটের ভেতর দলা পাকিয়ে থাকা ভারতীয় ডাল, চিনি, পেঁয়াজের কথা না হয় না তুললাম। তো, ভারতপ্রীতির অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংসদেরা এ ভাষায় এক খালেদা জিয়ার সঙ্গেই পারবেন না। কারণ, তাঁর প্রথম মাতৃভাষা তো হিন্দি। সূত্র: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, ‘ওনার (খালেদা জিয়া) জন্ম তো ভারতে।’ তার মানে, বক্তৃতার ভাষা হিন্দি হলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্য মঞ্চটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকবে না। অবশ্য আশার খবরও আছে। খালেদা জিয়া সংসদে প্রায় আসেনই না।
অবশ্য ভাষা হিন্দি হলে পুরো কর্তৃত্ব নারী সাংসদদের হাতে চলে যাওয়ার ভয় আছে। কারণ, বাংলার আকাশ ভরা হিন্দি সিরিয়াল। নারী দর্শকেরা হিন্দি সিরিয়ালের বেশুমার ভক্ত হওয়ায় হিন্দির প্রভাব তাঁদের জীবনে ব্যাপক। আর পুরুষেরা, নিশ্চয় এত দিনে তাঁরাও কিছুটা সংক্রমিত। তবে তা জানা-বোঝার পর্যায়ে হয়তো। এ দক্ষতা দিয়ে মন ভরে গালমন্দ করা যাবে বলে মনে হয় না।
বক্তৃতার ভাষাটা উর্দু হলে কেমন হয়? জামায়াতের পোয়াবারো। সুসংবাদ, তাঁরা সংখ্যায় কম। আবার বিএনপির দেখাদেখি সংসদেও কম আসে। তবে নিশ্চিত বলা যায়, একবার হয়ে গেলে ‘ভাষার টানে’ তাঁদের উপস্থিতি বাড়বে। বিএনপিকে ছেড়ে একা একাও চলে আসতে পারে। কিন্তু বাকিদের কী হবে?
সাত-পাঁচ না ভেবে ভাষাটা ইংরেজি করে ফেলাই ভালো। প্রভুদের ভাষা। কূটনৈতিক কারণে এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত—সব এক। এ প্রস্তাবটি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। মত এসেছে, ভাষা ইংরেজি হলে সর্বোচ্চ গালি শুনতে হতে পারে ‘স্টুপিড’। বাংলায় যা ছিল ‘চুপ, বেয়াদব’! শুনতে বড্ড লাগত।
বক্তৃতার ভাষা ইংরেজি হলে কিছু নতুন অর্থনৈতিক উদ্যোগও আশা করা যাবে। রাজনীতিবিদদের ইংরেজি শেখানোর জন্য কোচিং সেন্টার, শুধু রাজনীতিকদের জন্য বিশেষ আইইএলটিএসের মতো ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে।
নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এ ব্যবসায় সবচেয়ে ভালো করবেন আমাদের প্রিয় বাবর। একে তো তিনি রাজনীতিবিদ; দ্বিতীয়ত, দেশি ইংরেজি বলায় পারদর্শী। শুধু নিজের নামে প্রতিষ্ঠান করেই তিনি এই ব্যবসায় জমিয়ে দিতে পারেন। ধরুন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম হবে—বাবর একাডেমি। প্রতিষ্ঠানের স্লোগান হবে ‘লুকিং ফর ছাত্রজ’। বাবর একাডেমিতে ভর্তি হলে ঢাকায় আপনি অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গিয়ে ক্লাস করার সুযোগ পাবেন। টিএফআই সেল ও সিআইডির দপ্তরে। ক্লাস শুরুর সময় রিমান্ডের ফাঁকে। আনফিট ছাত্ররা ক্লাস করতে পারবেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে, একাডেমির অধ্যক্ষ বাবর এখানে প্রায়ই যান। এর বাইরে আদালত এলাকায় হতে পারে মোবাইল ক্লাস, প্রিজন ভ্যানের ফাঁক গলে।
ঢাকার বাইরে থেকে বাবর একাডেমিতে ইংরেজি শিখতে চাইলে আপাতত সুযোগ আছে কাশিমপুরে। এটা হবে মূলত অনুশীলন ক্লাস—অবসরে জাবর কাটা। এ ছাড়া হবিগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে (কিবরিয়া হত্যা মামলায় হাজিরার ফাঁকে) পাবেন ভ্রাম্যমাণ ইংরেজি শেখার সুযোগ।
এ উদ্যোগ কার্যকর হলে যে গালাগাল হারিয়ে যাবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। যে কেউ আগামী ফেব্রুয়ারিতেই একটা বই প্রকাশ করতে পারেন। বইয়ের নাম হতে পারে বাংলার খিস্তিখেউড়: সংসদের এক্সপাঞ্জ করা সব বক্তৃতার সংকলন।
শাহেদ মুহাম্মদ আলী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২২, ২০১০
Leave a Reply