বইমেলায় ঢুকতেই কিছু দিশেহারা মানুষ দেখা যায়। কেউ সঙ্গে আসা প্রিয়জনকে খুঁজে পান না, কেউ মোবাইলের নেটওয়ার্ক পান না। কেউ পান না কাঙ্ক্ষিত কোনো স্টল। এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—আচ্ছা ভাই, ৪১৩ নম্বর স্টলটা কোথায় বলতে পারেন? পুরো মেলা চারবার চক্কর দিয়েছি। কোথাও নেই।
—তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ করুন।
—ভালো বলেছেন তো; আচ্ছা, তথ্যকেন্দ্রটা কোথায়?
পুরো মেলা চারবার চক্কর দিয়েও তথ্যকেন্দ্র দেখেননি, আর ৪১৩ নম্বর স্টল দেখে ফেলবেন, তা কীভাবে হয়? তবে এমন নিবেদিতপ্রাণ পাঠকের সংখ্যা খুব কম নয়। বইমেলায় এসেছি, শুধু বই-ই দেখব—তাঁরা এ নীতিতে বিশ্বাসী। অন্য কোনো কিছুর দিকে তাঁদের খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। তবে মেলায় আসা দর্শনার্থীরা বই কেনার চেয়ে ঘোরাঘুরি, ছবি তোলা আর ভুট্টা-বাদাম চিবানোতেই বেশি সময় ব্যয় করেন। মেলার ক্যান্টিনে খাবারের দাম বেশি—তাতেই যে ভিড় থাকে, অনেক স্টলে তার অর্ধেক ভিড়ও থাকে না। এতেই প্রমাণ হয়, সবার ওপরে খাওয়া সত্য! আর ছবি তোলা নিয়ে তো রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। মেলায় এসে অমর একুশে ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ভাব নিয়ে কয়েকটা ছবি না তুললে মেলায় আসাটাই বৃথা। আর কোনো লেখক দেখলে তো কথাই নেই। ভক্তরা দৌড়ে গিয়ে ছবি তুলতে চান। লেখকও ভক্তের পাশে দাঁড়িয়ে মুখে একটা রেডিমেড হাসি এনে ছবি তোলেন। প্রিয় লেখকের ছবি তোলার উত্তেজনায় অনেকে ক্যামেরা অন না করেই গোটা পাঁচেক ছবি তুলে হাসিমুখে ধন্যবাদ দেন লেখককে। তবে ঘটনা টের পাওয়ার পর সেই হাসি কান্নায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগে না। মেলার নজরুল মঞ্চে কবি নজরুলের একটা মূর্তি রয়েছে। লোকজন মূর্তিটার পাশে দাঁড়িয়ে, কাঁধে হাত রেখে, জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ছবি তোলেন, দেখে মনে হয় কবি নজরুল তাঁদের ইয়ার-দোস্ত, ছোটবেলায় তাঁরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতেন, অনেক দিন পর দেখা হয়েছে! এই নজরুল মঞ্চেই মেলায় আসা নতুন বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এমনিতে মোড়ক উন্মোচনের ব্যাপারে সাধারণ দর্শকদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও, আশপাশে মিষ্টির প্যাকেট থাকলে তাঁদের আগ্রহের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। তখন তাঁদের আগ্রহ দেখলে যে কারও মনে হবে—বই নয়, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন দেখতেই তাঁরা মেলায় এসেছেন। মোড়ক উন্মোচনের পর মিষ্টির প্যাকেট উন্মোচন করার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টির প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। যাঁদের জন্য মিষ্টি আনা হয়েছে, তাঁরা কেউই পাননি—এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে অনেকে প্রতিটি মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং লেখক বা মোড়ক উন্মোচনকারীর পাশে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এতেও অনেক সুবিধা। টিভিতে নিজের চেহারাটা দেখানো যায়, আর মোড়ক উন্মোচনের পর একটা বইও পাওয়া যেতে পারে। তবে এ জন্য দীর্ঘদিনের সাধনা প্রয়োজন।
বইমেলায় সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি অনেকেই আছেন, যাঁরা মার্ক টোয়েনের অনুসারী। মার্ক টোয়েন নাকি বই নিয়ে আর ফেরত দিতেন না। মেলায়ও তাঁর শিষ্যরা ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা বিভিন্ন স্টলে গিয়ে পছন্দের বইটি নিয়ে সুযোগ বুঝে নিশ্চিন্তে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যান। স্টলের বিক্রেতারা হঠাত্ টের পান,
— আরে! এখানে গাধা বইটা ছিল, গেল কই?
— হায় হায়! বল কী? গাধা নাই? ভালোমতো খুঁজে দেখ।
— নাহ্, গাধাটা নিয়ে গেছে।
— মিয়া, স্টলে বইসা কি মুড়ি খাও নাকি? চোখের সামনে থেকে বই লইয়া যায় কেমনে? তোমার চোখ কোন দিকে থাকে তা কি বুঝি না ভাবছো?
— আমি কি সিসি ক্যামেরা নাকি? আপনি খেয়াল করলেন না কেন? আপনি তো বামপন্থী, বাঁ দিকটা তো আপনার খেয়াল করার কথা ছিল।
— কী কইলা? সব যদি আমি খেয়াল করি, তাইলে তোমারে রাখছি ক্যান? তুমি কি নবাব আলীবর্দি খাঁর নাতি নাকি? কাজে ফাঁকি দাও!…
এভাবে ঝগড়া চলতেই থাকে। আর ওদিকে বইচোর চুরি করা বইটা নিয়ে লেখকের কাছে গিয়ে বলেন,
—স্যার, আমি আপনার বিশাল ভক্ত। আপনার সব বই আমি সংগ্রহ করি। প্লিজ, একটা অটোগ্রাফ দিন।
লেখক বইটা হাতে নিয়ে বড় হও, মানুষ হও—এই টাইপের কথা লিখে খুশিমনে অটোগ্রাফ দেন। বইটা কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে তা জানলে হয়তো কলম দিয়ে অটোগ্রাফ দিতেন না। তখন ওই ব্যক্তির শরীরে কিল-ঘুষির মাধ্যমে অটোগ্রাফ দেওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকত।
আড্ডার মাধ্যমে নাকি ফ্রান্সের স্বাধীনতা এসেছিল। আর তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই হয়তো মেলায়ও লেখক-শিল্পীদের আড্ডা দেওয়ার জন্য আলাদা জায়গা দেওয়া হয়েছে। তবে লেখকেরা বিভিন্ন স্টলে অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত থাকায় এখানে তাঁদের খুব কমই দেখা যায়। মাঝেমধ্যে কিছু উঠতি লেখক এখানে বসেন এবং বইমেলা বাংলা একাডেমী থেকে সরানো উচিত কি না, কিংবা মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া সাহিত্যের বাণিজ্যিকীকরণের শামিল কি না, তা নিয়ে তুমুল বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। মনোযোগ দিয়ে টক-শোর মতো এই বিতর্ক উপভোগও করেন অনেকে। এই বিতর্ক দেখারও একটা আলাদা মজা।
পুরো মেলাতেই এমন অনেক মজা আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে নতুন হলো, ‘বই কিনলে জুস ফ্রি’ অফার! নির্দিষ্ট ওই বইটা কিনে পড়ার পর লেখকের প্রতি রাগে-ক্ষোভে যদি আপনার মাথা গরম হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, তখন ওই ফ্রি পাওয়া জুস আপনাকে কিছুটা শান্তি দেবে—এই আশাতেই হয়তো ‘বই কিনলে জুস ফ্রি’ পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে। আহা! বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রকাশনী শিল্প কতটা এগিয়ে যাচ্ছে! ভাবতে ভালোই লাগে।
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply