আগে মানুষ পড়ালেখার পাশাপাশি প্রেম করত, এখন প্রেম করার পাশাপাশি পড়ালেখা করে। অনেকে আবার প্রেমের ব্যস্ততার কারণে পড়ালেখাই ছেড়ে দিয়েছে। ‘তুমি কিসে পড়?’ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘আমি প্রেমে পড়ি।’ আমার অনেক বন্ধুর আবার বাসার সদস্যসংখ্যার চেয়ে প্রেমিকার সংখ্যা বেশি। এত প্রেমিকের মধ্যে প্রেম না করে নিশ্চিন্তে যে বসে থাকব, তারও উপায় নেই। সবাই আমার কাছে বুদ্ধি চায়, ‘একই দিনে দুজনের জন্মদিন, দুজনই বলেছে, আজকে দেখা না করলে ডিলিট! কী করব?’
যেন আমার কাজই বুদ্ধি দেওয়া। আজও রিয়াদের ডাকে সাড়া দিয়ে ওর সঙ্গে যেতে হচ্ছে। প্রকৃতির ডাক চেপে রাখা যায়, কিন্তু রিয়াদের ডাকে সাড়া না দিলে ২০ কেজি ওজনের ঘুষি খেতে হবে। রিকশায় উঠেই রিয়াদ এমনভাবে ওর প্রেমিকাকে ফোন দিল, যেন রিকশায় উঠলেই প্রেমিকাকে ফোন দিতে হবে। আর কথা বলার সে কী কায়দা! ‘হ্যালো জানু, কী কর? ভাত খাও? কী দিয়ে খাও? আরে গরুর মাংস তো আমারও খুব প্রিয়, কী রঙের গরু? সেকি! রং তো জানতেই হবে। আমি আবার লাল গরুর মাংস খাই না, আমাকে লাল গরু গুঁতো দিয়েছিল তো, কোথায় গুঁতো দিয়েছিল? ইয়ে… জানু, আমি রাস্তায় আছি তো, অনেক শব্দ, কথা শুনতে পাচ্ছি না।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘জানু জানু করছিস কেন? জানুয়ারি মাস তো চলে গেছে, তুই ফেব্রু ফেব্রু বলে ডাক।’
ফেব্রুয়ারি মাসে জানু ডাকলে তোর কোনো অসুবিধা আছে?
আমাদের বুয়ার নাম জানুর মা। জানু শুনলেই বুয়ার কথা মনে হয় আর বলতে ইচ্ছা করে, জানুর মা, এক কাপ চা…
মুখ সামলে কথা বল! আর পারলে আমাকে বুদ্ধি দে। ও জানতে চেয়েছে, গরু কোথায় গুঁতো দিয়েছিল। এখন ওকে কী করে বলি?
তোরই তো গার্লফ্রেন্ড। সাহস করে সত্য কথাটা বলে দে। পুলিশ, ডাক্তার আর প্রেমিকা, এদের কাছে মিথ্যা বললে ধরা খাবি।
আমার জায়গায় তুই থাকলে কি গার্লফ্রেন্ডকে এই কথা বলতে পারতি?
তোর জায়গায় থাকলে আমি গরুর গুঁতোই খেতাম না।
প্লিজ দোস্ত, আমাকে বাঁচা।
ফোনটা দে, আমি বলে দিচ্ছি কোথায় গুঁতো দিয়েছিল।
আরে পাগল নাকি! ওটা তো আমিই বলতে পারি। কীভাবে ঘটনাটা এড়ানো যায় সেটা বল, আমার মাথায় কোনো কিছু আসছে না।
আরে দূর, বাদ দে। এটার কথা ও ভুলেই যাবে।
তিথিকে আমি খুব ভালো করে চিনি। ওর স্মৃতিশক্তি মারাত্মক। স্কুল-কলেজে স্মৃতিশক্তি পরীক্ষার খেলায় ও সব সময় ফার্স্ট প্রাইজ হিসেবে ডিকশনারি পেয়েছে। ওর বাসা ভর্তি ডিকশনারি।
এত কথা বলছিস কেন? চান্স পেলেই প্রেমিকার প্রশংসা—এই কন্ডিশন তো ভালো না। চুপচাপ বসে থাক। তিথি আসুক, তারপর দেখা যাবে কত ভুট্টায় কত পপকর্ন। ওই যে, এসে গেছে।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু তুই বসে আছিস কেন? যা ভাগ!
আমি উঠে যাওয়ার আগেই তিথি এসে বলল, কেমন আছ? আজকের ওয়েদারটা সুইট না? কোথায় যাচ্ছেন?
আমার একটু কাজ আছে।
একদিন কাজ না করলে কী হয়, ভাইয়া? আপনি বসেন তো। বসে একটা বুদ্ধি দেন। সামনে ভ্যালেন্টাইনস ডে, এই দিনে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। দিনটাকে কীভাবে পালন করা যায়? আপনার বন্ধুর মাথা তো বুদ্ধিশূন্য।
ফকিরকে খিচুড়ি খাওয়াতে পারেন। তারা খাস দিলে দোয়া করবে!
রিয়াদ গর্জে উঠল, তোর কি মাথা খারাপ, না কি তুই মাথা খারাপের ভান করছিস? ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে ফকির খাওয়াব কেন? তুই খাওয়া! আমি নিজে ফকির জোগাড় করে দেব। দেখি কত খাওয়াতে পারিস।
তিথি অবাক হয়ে বলল, আশ্চর্য! তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আমার কাছে তো ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। লাইন দিয়ে ফকিররা বসে আছে। তুমি পাতিল নিয়ে আসছ আর আমি সবার প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছি। সবাই তৃপ্তি করে খেয়ে আমাদের জন্য দোয়া করছে। সুইট একটা ব্যাপার। কি, সুইট না?
অবশ্যই সুইট! একেবারে বিক্রমপুরের খাঁটি সুইট। ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফকির খাওয়ানো, পত্রিকার হেডিংয়ে চলে আসার মতো ঘটনা!
রিয়াদ ওর মোটা কনুই দিয়ে আমাকে গুঁতো মেরে কানে কানে বলল, ফকির খাওয়ানোর বুদ্ধি দাও! তোর খবর আছে। আর যদি তিথির সামনে আসিস, একেবারে হাঁটু ভেঙে দেব!
তিথি আবার বলল, ওনার মাথায় কত বুদ্ধি! তোমার বুদ্ধি নেই কেন? তুমি ওনার সঙ্গে বেশি করে মিশবে।
রিয়াদ হাসিমুখে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই মিশব। কিন্তু আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলল, বুদ্ধি দাও, না! বুদ্ধিজীবী হয়েছ? চাইলেই বুদ্ধি দিতে হবে? খবরদার, আর কোনো বুদ্ধি দিবি না। একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলব। বলেই আবার তিথির দিকে তাকিয়ে মধুস্বরে বলল, তিথি, তোমাকে আজ খুব সুইট লাগছে।
এই, তুমি বারবার কনুই দিয়ে ওনাকে গুঁতো মারছ কেন? কী হয়েছে?
আরে ও ভালো বুদ্ধি দিয়েছে তো, তাই গুঁতো মেরে ওকে বাহবা দিচ্ছি।
ও, তাই বলো। আচ্ছা, ভালো কথা, তুমি না বলেছিলে তোমাকে গরু গুঁতো দিয়েছিল? ঘটনাটা বলো তো, কোথায় গুঁতো দিয়েছিল?… কী হলো, বলছ না কেন?
রিয়াদ করুণ চোখে তিথির দিকে তাকিয়ে কনুই দিয়ে বারবার আমাকে গুঁতো দিতে লাগল। ইস, বেচারা রিয়াদ! রানওয়েতে এসে প্লেন ক্র্যাশ। এখন আমার কাছে বুদ্ধি চেয়ে কী লাভ? তুই তো বুদ্ধি দিতে মানা করেছিস। বন্ধুর কথা মেনে না চললে খারাপ দেখায়। তাই আমি মুখ বন্ধ রেখে কনুইয়ের গুঁতো খাচ্ছি, ভালোই লাগছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply