সামনে ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। তখন এ জন্য চোখ-কান বুজে কোচিং করতে হতো না। হাতে অফুরন্ত অবসর। দুম করে একদিন ভর্তি হয়ে গেলাম ড্রাইভিং স্কুলে। সম্পর্কে তিনি পাড়াতো চাচা। নিজের একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি দিয়ে নিজেই ড্রাইভিং শেখাতেন।
কিছুদিনের মধ্যে আমার ওপর প্রেম পড়া শুরু হলো। আর সেই প্রেম উদয় হয় জানালায়। আমি সাড়ে ছয়টায় হাজির হই। একটু পরেই বাড়ির একটা জানালা খুলে যায়। একটি সুন্দরী বালিকাকে দেখি, যতক্ষণ গাড়ি নিয়ে বের না হই, ততক্ষণ বালিকাটি জানালায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ভোরের ঘুম বাদ দিয়ে ড্রাইভিং শেখা অতিদ্রুত আমার কাছে ব্যাপক প্রিয় হওয়া শুরু করল।
দিন যায়, আমি বালিকাকে দেখি, বালিকা আমাকে দেখে। তার পরই রচিত হলো আসল নাটক। একদিন বালিকার বাবা আমাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসালেন। চা খেতে খেতে যখন খাবি খেলাম, তখন দেখি সেই বালিকাও হাজির। আমার পাড়াতো চাচা আনুষ্ঠানিকভাবে আমার সঙ্গে তাঁর মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, উনি তোমার আঙ্কেল হন, সালাম দাও।
সেই বয়সে আঙ্কেল হয়ে আমার ভালোবাসাবাসি সেখানেই ইতি ঘটেছিল। কে যেন বলছিল, ভালোবাসা একটা বাজারের মতো। এখানে যেতে কোনো প্রবেশমূল্য লাগে না, কিন্তু বের হতে গেলে কিছু না কিছু মূল্য দিতেই হয়। আমি সেই বয়সে আঙ্কেল হয়ে এর মূল্য দিয়েছিলাম।
আমার মতো এত সহজে সবার নিষ্কৃতি কিন্তু হয় না। শেফালী রানির কথাই বলি। প্রেমকুমারের সঙ্গে দেড় বছরের সম্পর্ক তার ভেঙে গেল। সম্পর্ক ভাঙার পর প্রেমকুমার শেফালী রানিকে একটি চিঠি লিখল। জ্ঞানপিপাসু পাঠক-পাঠিকার জন্য সেই চিঠিটাই বরং এখানে তুলে দিই।
এক সময়ের প্রিয় শেফালী রানি,
আমার সঙ্গে দেড় বছরের সম্পর্কের জন্য ধন্যবাদ। যখন তুমি এই চিঠি পাবে, তখন তুমিও নিশ্চয়ই আরেকজনকে খুঁজে নিয়েছ।
শেফালী, তোমার অভাব পূরণ করতে আমি আরেকটি মেয়েকে খুঁজে নিয়েছি। ফেসবুকে ফ্রেন্ডলিস্টে তোমার পরেই ছিল তার নাম। আমি তোমাকে একসময় প্রচুর ভালোবাসার চিঠি লিখেছিলাম। এ রকম আবেগঘন চিঠি লেখা যে সহজ নয় তা তুমি নিশ্চয়ই মানবে। আর আগের মতো এখন এত সময় কই। চিঠি লেখার সময় বাঁচাতে তোমাকে লেখা আমার সব চিঠি আমি ফেরত চাই। সেসব চিঠিতে হোয়াইটেনার ব্যবহার করে তোমার নামটা মুছে দিয়ে তার নাম লিখে দেব। আগে বুঝতে পারলে সবগুলো চিঠির ফটোকপি করে রাখতাম।
শেফালী, আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা দিয়েছিলাম। সেটাও কি ফেরত দিতে পারবে? তুমি জান যে এটাই একমাত্র ছবি, যেখানে আমাকে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম লাগে। তোমার নিশ্চই মনে আছে, ফেসবুকে এ ছবি দেখেই তুমি আমার প্রেমে পড়েছিলে। এই ছবিটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলেই ফেরত চাইছি।
শেফালী, আমরা একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম। কফিশপে গেছি, সাইবার ক্যাফে যেতে হয়েছে, অনেক উপহারও দিয়েছিলাম। কেবল তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়া আর কি। আমি তোমার পেছনে যত খরচ করেছি তার একটা তালিকা করেছি। দুপুর ও রাতের খাওয়া ও স্ন্যাকস—আট হাজার ৪৫০ টাকা, সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখা—৯০০ টাকা, মোবাইল ফোনের বিল—সাত হাজার ৫০০ টাকা, গাড়ির তেল—তিন হাজার টাকা, অন্যান্য গিফট—এক হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ২১ হাজার ৩৫০ টাকা। দয়া করে দ্রুত বিলটা মিটিয়ে দিলে আমি আমার নতুন প্রেমিকার পেছনে খরচ করতে পারি। তোমার কাছে আমার দেওয়া কোনো উপহার থাকলে তাও ফেরত দিতে পার। সে ক্ষেত্রে বিল কিছুটা সমন্বয় করা যেতে পারে। তোমারও কিছু পাওনা থাকলে আমাকে বিল পাঠাতে পার। যদিও যত দূর মনে পড়ে, ডেটিংয়ের সময় তুমি সর্বদাই পার্স আনতে ভুলে যেতে। তোমার নতুন জীবনের শুভ কামনায়—
তোমার সাবেক প্রেমিক।
পাঠক, ভালোবাসা দিবসের লেখায় প্রথমে ব্যর্থ ও পরে হিসাবি প্রেমিকের কাহিনির পর এবার ভালোবাসা সফল করার মূল সূত্রটা বলি—তাতে যদি আপনারা খুশি হন। যারা মনে করেন, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হওয়াই সফল ভালোবাসার উদাহরণ, তাঁরা ভুল জানেন। বরং আপনাদের শিখতে হবে কীভাবে বিবাহিত জীবনটা সফল করা যায়।
আমার জীবন থেকেই উদাহরণটা দিই। আমি আমার বউয়ের সঙ্গে কখনো ঝগড়া করি না। আমরা বিয়ের প্রথম দিনই দ্বিপক্ষীয় সংলাপের মাধ্যমে সংসারজীবনের সনদ বা সমঝোতা তৈরি করে নিয়েছি। যেমন, আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি বড়, তাই বড় বিষয়গুলো নিয়ে আমিই মাথা ঘামাব। সেই হিসাবে ওবামা নির্বাচিত হতে পারবে কি না, প্যালেস্টাইনে শান্তি ফিরে আসবে কি না, মার্কিন অর্থনীতির মন্দা কত দিন থাকবে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি কতটা ভালো করবেন, আইএমএফের ঋণ নেওয়া ঠিক হবে কি না—এসব বড় বড় বিষয়ে আমিই সিদ্ধান্ত নেব। এসব ব্যাপারে আমার স্ত্রী নাক গলাবে না। আর রান্না কী হবে, শ্যালিকার ছেলের জন্মদিনে কী উপহার কেনা হবে, মেয়ে কোন স্কুলে যাবে, ডিপ ফ্রিজ না ওয়াশিং মেশিন কেনা হবে, শ্যালকের বিয়েতে কত টাকা দামের গয়না কিনব—এসব ছোটখাটো বিষয়ে আমার বউই সিদ্ধান্ত নেবে। আমি টাকা দেওয়া ছাড়া একেবারেই নাক গলাব না।
ভালোবাসা দিবসের আগে আগে এর চেয়ে ভালো ও কার্যকর উপদেশ আর কেউ দেবে না। তাও আবার মুফতে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply