‘প্রেম’ শব্দটা সম্ভবত খুব স্পর্শকাতর। মানুষ মুখে আনতে চায় না। ধরা যাক, রাশেদ আর মিতি নামে দুজনের মধ্যে প্রেম আছে। কিন্তু এটা নিয়ে যখন কথা হবে, তখন কেউ বলবে না তাদের মধ্যে প্রেম। বলবে, তাদের ‘অ্যাফেয়ার’ আছে, ‘রিলেশন’ আছে কিংবা ‘সম্পর্ক’ আছে। ছোটবেলায় আমাদের মফস্বলে প্রেমের আরেকটা বিকল্প শব্দ প্রচলিত ছিল। লাইন। মিতির সঙ্গে রাশেদের ‘লাইন’ আছে। বেহায়া গোছের কেউ হলে বলবে, রাশেদ ও মিতি লাইন মারতেসে।
প্রেমের প্রতীকী গাণিতিক চিহ্ন ‘+’। খাগড়াছড়ির আলুটিলার গুহায়, ঢাকা চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচার বিপজ্জনক রেলিংয়ে, শিশুপার্কের নাগরদোলার দুরূহ উচ্চতায় ছুরি দিয়ে কেটে কেটে লেখা নামের যোগফল দেখেছি—‘মজনু+বিলকিস’। শৈশবে প্রেম আমার মনে যে ইমেজ তৈরি করত তা অবশ্য সিনেমায় দেখা কলেজ ক্যাম্পাসের। সেখানে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র জসিম বুকের বোতাম খুলে দিয়ে একটা পাঠ্যবই হাতে সিরিয়াস ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেন। ওই একই সময়ে কলেজগার্ল শাবানা সিঁড়ি বেয়ে নামতেন। সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাঁদের সংঘর্ষ হতো। দুজনের হাত থেকে বই পড়ে যেত। বই তুলতে তুলতে চোখে চোখ পড়ত। তারপর নায়িকার সিরিয়াস ধমক, ‘দেখে চলতে পারেন না? হাঁটার সময় চোখ কোথায় থাকে?’ চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই নায়কের অ্যাপলজি, ‘দেখেই তো চলছিলাম!’ এই দৃশ্যের দু দৃশ্য পরেই মাকে কদমবুসি করতে করতে ‘মা, আমি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি’, ‘আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত’, ইত্যাদি ইত্যাদি এবং একটুও সময় নষ্ট না করে একই সঙ্গে এফডিসির বাগান ও কক্সবাজারের সৈকতে নায়ক-নায়িকার যুগল নৃত্য (যার ক্যাপশন হতে পারত ‘সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড’)। এই নৃত্যটাকেই ভাবতাম প্রেম। ‘লাইন’।
আর প্রেমের মাধ্যম ছিল চিঠি। প্রেমে চিকিচক্ করতে থাকা একটা চিঠি আমিও পেয়েছিলাম। সারা জীবনে ওই একটাই। ক্লাস টেনে পড়ি তখন। স্কুলের কেরানি একদিন ডেকে পাঠালেন। ‘তোমার নামে চিঠি আছে।’ দেখি খামের ওপর গোটা গোটা করে আমার নাম, সেকশন আর রোল নম্বর লেখা। বাসায় ফেরার পথে সে চিঠি খুলে প্রথমবারের মতো বুঝলাম, প্রেমের কত গভীর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ সম্ভব! নাইন-টেনের রসায়ন বইয়ে শেখা অসংখ্য রাসায়নিক মৌল ও তাদের নানা রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মানব-মানবীর হূদয়বৃত্তিক অভিব্যক্তির অভাবনীয় সব প্রতীকায়ন। ‘তুমি যদি সোডিয়াম আয়ন হও, আমি ক্লোরাইড আয়ন। আয়নিক বন্ধনের মাধ্যমে আমরা কবে সোডিয়াম ক্লোরাইড হব, তানিম?’
চিঠি এখন আর কেউ লেখে না। মোবাইল ফোন চিঠির শিল্পকলাকে খুন করেছে অনেক দিন হলো। তার পরও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আমার এক বন্ধুকে তেঁতুলিয়া থেকে এক মেয়ের লেখা চিঠির কথা মনে পড়ছে। বন্ধুটির ‘সৌজন্যে’ সে চিঠিগুলো পড়ার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। মেয়ের বাক্যগঠনে একটু দুর্বলতা ছিল। মাঝে মাঝে বাক্যে নানা বিপর্যয় ঘটত। যেমন, একটা চিঠিতে সেই মেয়ে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে নিচে লিখে দিয়েছিল, ‘এই নম্বরে যদি কল না করেন, তাহলে বুঝব আপনি আমাকে ভালোবাসেন’!
না, চিঠি এখন আর কেউ লেখে না। ‘+’ চিহ্নের ব্যবহারও মনে হয় আর নেই। তরুণ-তরুণীর ‘অ্যাফেয়ারে’ একটা বিপ্লবই ঘটিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তখন রাতভর বিনা পয়সায় কথা বলার নানা প্যাকেজ চালু হলো। প্রতিটি রাতেই এক হল থেকে আরেক হলে যাওয়ার সময় প্রেমের নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রবাহ আমি যেন অনুভব করতে পারতাম। হলের প্রতিটি কোণাকৃতি অঞ্চলে, লোকচলতি ভাষায় ‘চিপায়’, কেউ না কেউ মোবাইল কানে পায়চারি করছে। শীতে কথা বলাটা ঝামেলার। সারা রাত কানে ফোন ধরে থাকলে হাত ব্যথা হয়ে যায়, কানেও ঠান্ডা লাগে। তাই আমার এক রুমমেট দুর্দান্ত একটা স্ট্র্যাটেজি বের করেছিলেন। তিনি কানে মোবাইল রেখে তার ওপর দিয়ে মাফলার পেঁচিয়ে দিতেন! (মোবাইলের সঙ্গে হেডফোন লাগিয়ে কথা বলার ফ্যাশন তখনও শুরু হয়নি) আমার আরেক বন্ধু প্রেমের এমন সুলভ বাজারেও প্রেমে পড়তে ব্যর্থ হয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিল। বন্ধুদের আড্ডায় নিজের দুঃখের গল্প বলতে বলতে একদিন সে হঠাত্ ক্ষেপে উঠল। ‘দাঁড়া, এখনি প্রেম করে দেখাচ্ছি!’ মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু নম্বর টিপে সে ডায়াল করল। ও প্রান্তে কল রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, ‘আপনি যে-ই হোন না কেন, আপনাকে আমি ভালোবাসি!’ ও প্রান্ত থেকে একটা বিশুদ্ধ পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল, ‘ভাই, আপনে কেঠা? এইটা কোন্ জায়গার নাম্বার, ভাই? এইটা কি ঢাকা?’
আমার আরেক বন্ধুর এক দুর্লভ গুণ ছিল। সে মেয়েদের গলা হুবহু নকল করতে পারত। মেয়েদের গলায় সে তার পাশের রুমে থাকা এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে সুদীর্ঘ তিন মাস প্রেম চালিয়ে গেছে। প্রতি রাতেই ১০টা-১১টার দিকে এক মনোহর দৃশ্যের অবতারণা হতো। আমার বন্ধুটি তার রুমে শুয়ে শুয়ে কথা বলত, আর বড় ভাইটি পাশের বারান্দায় অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে কথা বলতেন। মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে গিয়ে হলের গার্ডদের কাছ থেকে কার্ড কিনতেন। বড় ভাইয়ের সে দৌড় দেখার জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম! আর বন্ধুটির কার্ডের খরচ জোগাতাম আমরাই, যাদের জন্য তামাশা দেখাটা খুব প্রয়োজনীয় একটা বিষয় ছিল।
মোবাইল প্রযুক্তি বোধ হয় এভাবেই মধ্যবিত্তের প্রেমকে একই সঙ্গে সুলভ এবং দুর্লভ করে তুলেছে। ধূর্তও কি করে তোলেনি? বাঘের খাঁচার রেলিংয়ে কিংবা নাগরদোলার চূড়ান্ত উচ্চতায় প্রেমের স্মারক রেখে আসার মধ্যেই বরং এক ধরনের সরল সৌন্দর্য আর সাহস দেখি আমি। ওই আবেগের মধ্যে কপটতা ব্যাপারটি নেই। এই আবেগগুলো মনে হয় দিন ঠিক করে উদ্যাপনও করতে হয় না। আবেগগুলো প্রতিদিনের, কিংবা বাংলা ছবির ভাষায়—চিরদিনের।
ও, আরেকটা কথা। আর্বিট্রারি নম্বরে ডায়াল করে প্রেম নিবেদন করা আমার বন্ধুটিকে এখনো কিন্তু সেই লোক মাঝে মধ্যেই কল করে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, এইটা কোথাকার নাম্বার ভাই!’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply