ভালোবাসা দিবসেই ওয়েলকাম টিউনে প্রেমের গান লাগাতে হবে—সুমীর এই খ্যাতনেসটা আমার অসহনীয় হলেও শুনতে লাগলাম। কর্কট রাশির মেয়ে। একবার বেঁকে বসলে সমস্যা।
‘হ্যালো।’ গম্ভীর গলা ওর। তুলি খালার মেয়ে ও।
‘সরি, আসছি, এক্ষুনি আসছি।’ চোর প্রেমিকের বড় গলা।
‘সবাই ভোর থেকেই ভালোবাসা স্টার্ট করে দিয়েছে, আর তুমি কিনা, এখন প্রায় একটা বাজে—।’
‘তাতে কী? ভালোবাসা কি মাছ না দুধ যে দুপুর গড়ালেই নষ্ট হয়ে যাবে?’
‘তোমারটা হতেও পারে—কোনো গ্যারান্টি নেই।’
‘ডোন্ট ওরি। কামিং। আর শোনো, ওই আমেরিকান বার্গার বা অ্যারাবিয়ান শোয়ার্মা-ফোয়ার্মা না—সরাসরি শেরাটনে আসো। ওখানে টার্কিশ বুফে ট্রিট পাচ্ছ শর্তসাপেক্ষে। ওই নাকফুলটার সঙ্গে পিংক জর্জেটটা পরে আসতে হবে কিন্তু। ডান?’
‘ও-কে, ডান!’ রাগীস্বর এখন আহ্লাদে পরিণত হয়েছে।
দুই.
লবিতে পিংক জর্জেটে পেছন ফিরে বসায় সুমীকে সারপ্রাইজ দেওয়ার একটা সুযোগ হলো। আস্তে করে পেছনে গিয়ে চোখ চেপে ধরলাম ওর।
‘ছাড়ো, লোকে দেখলে কী ভাববে—এই বুড়ো বয়সে!’
‘অ্যাঁ! সব্বনাশ!’—এ তো দেখি তুলি খালা পিংক জর্জেটে।
সম্মোহিতের মতো বসে পড়ি সামনাসামনি। বড় বড় চোখে দুজন চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ। অতঃপর মাথা নিচু।
‘তুই?’ নিচুস্বরে বলেন খালা।
‘ইয়ে, খালা, এখানে তো সুমীর আসার কথা।’
‘বলিস কি? সুমী কী করে আসবে? ওর তো জ্বর, গলায় ইনফেকশন। শুয়ে আছে!’
‘কিন্তু আমি যে ফোন করলাম, কথা বললাম?’
‘অ্যাঁ আল্লাহ!’ চমকে ওঠেন খালা। ‘ওই ফোনটা তুই করেছিলি? আমি তো ভাবলাম তোর খালু!’ বলেই ফোন সেটে নম্বর দেখেন। আমিও দেখি আমারটায়। আর দুজনই চমকে উঠি। তোতলানো স্বরে বলি, ‘ভুলে তোমার নম্বরে চাপ পড়ে গিয়েছিল!’ মাথা নিচু করি। খালাও। তবে খালা মাথা নিচু করার সঙ্গে অবচেতনভাবে নাকফুলটায়ও টোকা দিতে থাকেন। মৃদুস্বরে বলি, ‘তোমাকেও নাকফুলে খারাপ লাগছে না খালা! আর!’ ‘আর?’ মাথা তোলেন খালা।
‘আর ভালোবাসা মানেই কি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকের মধ্যে ভালোবাসা? ভালোবাসা হবে বাবা-মেয়ের মধ্যে, ভালোবাসা হবে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে, ভালোবাসা হবে বাস ড্রাইভার-পুলিশের মধ্যে—আরে এসব কি?’
খালাও চার্জড হয়ে যান আমার কথায়। আরও উচ্চস্বরে বলেন, ‘ভালোবাসা মানে কি শুধু আমির-কারিনার বৃষ্টিভেজা জুবি ডুবি জুবি ডুবি ড্যান্স? দাঁড়া, তোর খালুকে ফোন দিয়ে ডেকে আনি। তিনজন মিলেই আজ ফ্যামিলি লাভ তৈরি করব!’
খালুর ফোন বন্ধ পেয়ে খালার মন কিছুটা ভারী হয়ে যায়। বলেন, ‘মরুক গে। চল। তুই হচ্ছিস আমার ভাগ্নে-কাম-হবু জামাই। আমি তোকে আদর করব না তো কি, অন্য মহিলা এসে আদর করবে? আয় কাছে আয়!’ আমি ফেসটা বাড়িয়ে দিই। খালা আমার কপালে সশব্দে একটা স্নেহের চুমু দেন।
‘এক্সকিউজ মি’, বলে ওঠে হোটেলের একজন, ‘এটা ওপেন স্পেস, ম্যাডাম। একটু দেখেশুনে!’
‘হ্যালো!’ খেপে ওঠেন খালা। ‘হি ইজ মাই সান। প্লিজ, অয়েল ইওর ওন মেশিন!’
ব্যাচারা কেটে পড়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে! ‘চল’, বলেন খালা। ‘রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক টার্কিশ বুফের জন্য। তখন থেকেই খিদেটা চাগিয়ে দিয়েছিস তুরস্কের টোপ দিয়ে। তোর কিপটা খালুর জ্বালায় গত তিন বছর কোনো ফাইভ স্টারের মুখ পর্যন্ত দেখতে পারিনি।’
তিন.
লাঞ্চ শেষে আমরা গাড়ি পার্কিং লটে রেখেই রিকশায় ঘুরে বেড়াই ভালোবাসার ঐতিহ্যের সন্ধানে। কোনো কোনো রিকশা থেকে আমাদের অসম জুটি দেখে ফিক ফিকে হাসি আসতে থাকে। আমরা তাতে থোড়াই কেয়ার করি। হঠাত্ ভূত দেখার মতো চিত্কার করে উঠি আমি!
‘কী হলো রে?’ তটস্থ খালা বলে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে বলি, ‘তুমি না বললে, সুমীর জ্বর?’ ‘হ্যাঁ। গলায়ও ইনফেকশন! কেন?’ ‘ওই তো দেখি সুমী! রাস্তার ওপারে রিকশার হুড তুলে কার সঙ্গে যেন বসে আইসক্রিম খাচ্ছে!’ ‘রাখ রাখ’, সান্ত্বনার কণ্ঠ খালার। ‘দেখি তো ফোন করে! নাহ, ফোন বন্ধ! তাহলে ওটা ভুতুম!’ ভুতুম সুমীর চাচাতো ভাই।
হঠাত্ আবারও ভূত দেখার মতো চিত্কার করে উঠি।
‘আবার কী হলো রে?’ খালার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।
‘সুমীর হাত থেকে আইসক্রিম ও খেল যে!’
‘তাহলে ভুতুমই হবে’, নিশ্চিন্ত হন খালা। ‘ভুতুম আইসক্রিম খুব পছন্দ করে। আর বোন ভাইয়ের থেকে খাবে না তো কী অন্যেরটা লুটপাট করে খাবে? তোর প্রবলেম কী? তোর সুমী তো তোরই থাকছে, বোকা!’
শান্ত হই আমি। চোখ মুছতে মুছতে বলি, ‘তাই?’
চার.
ধানমন্ডি লেকের পাড়ের বেঞ্চিতে খালার সঙ্গে চোখ চেপে ধরা খেলার এক ঘন্টা পর লেকে যখন খালা আর আমি নৌকায় প্যাডেল মারছি, তখন হঠাত্ খালাই চিত্কার করে আমার কাঁধে মাথা রাখলেন। কাঁদো কাঁদো সুরে বললেন, ‘কল্লোল, এ আমাকে কী দেখতে হলো রে? এর চেয়ে যে মরে যাওয়াও ভালো ছিল।’ ‘কী হয়েছে, খালা?’
‘ওই যে ওই বোটে দেখ, তোর খালু ওর এক্স গার্লফ্রেন্ড তুতলীকে নিয়ে ভালোবাসার প্যাডেল মারছে।’
চুপ করে থাকি তিন সেকেন্ড। শান্ত স্বরে বলি, ‘খালা! খালু আর তুতলী আন্টি ইকোনমিকসে পড়ত না?’
‘হ্যাঁ, কেন রে?’
‘বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় দুই ইকোনমিস্ট বসে বসে হয়তো অর্থনৈতিক আলোচনা করছেন প্যাডেলের ওপর!’
‘তুই বলছিস?’ চোখ মোছেন খালা, আধা বিশ্বাসী চোখে।
‘হ্যাঁ, ভালোবাসা দিবসে দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হয়তো ওনাদের এই ভ্যালেন্টোইনমিকস!’
‘ইকোনমিকস হোক আর হোম ইকোনমিকস হোক—বোট ঘোরা। সহ্য করতে পারছি না আমি!’ বোটটি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দ্রুত প্যাডেলে পা চালাই। খালাও তাল মেলাতে থাকেন—লেফট রাইট, লেফট রাইট!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply