কাবুল থেকে ওয়াশিংটনে এসেছিলাম। ভ্যালেন্টাইন দিবসের সকালবেলা পলের কাছ থেকে টেলিফোন পাই। ইরাক যুদ্ধের এ সাবেক সেনা কাবুলে আমাদের নিরাপত্তা প্রদান করে। পলও ওয়াশিংটন এসেছে সিকিউরিটিবিষয়ক ব্রিফিংয়ের কাজে। টেলিফোনে সে আমাকে তত্ক্ষণাত্ শহরতলির জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে হ্রদের পাড়ে আসতে বলে। এসে দেখি সদ্য পরিচয় হওয়া একটি মেয়েকে পল এখনই বিয়ে করতে যাচ্ছে। প্রস্তুতি চলছে, বেশ কজন মাথা চাঁছা ইরাক যুদ্ধের সাবেক সেনা মস্ত মস্ত সব পাথর নিয়ে টানাহেঁচড়া করে তৈরি করছে বিবাহের বেদি—হূদয়ের নকশা। একজন পাদ্রিকেও ডেকে আনা হয়েছে বিয়ে পড়ানোর জন্য। তাঁর চুলের ঝুঁটি থেকে লকলক করছে তাজা গোলাপ। গঞ্জিকা বৈধকরণ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তাঁকে গির্জা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। হূদয়ের নকশার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিপুলকায় পল মাথা কামানো ঘটোত্কচের মতো মচমচ করে পটেটো চিপস চিবোচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে সে আঙুল দিয়ে গলা কেটে হারিকিরির প্রতীক দেখিয়ে বলে, কনে এসে পৌঁছায়নি, সে মোবাইল ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। পাদ্রি দ্রুত বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য তাড়া দেন। তাঁর হাতে সময় স্বল্প, একটু পর তিনি খোদ হোয়াইট হাউসের সামনে যাবেন। মারিজুয়ানা মেডিক্যালি জায়েজ করার দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে তাঁকে দাঁড়াতে হবে তো।
আমাকে কিছু করতে হয়, তাই পলকে হিম্মত জুগিয়ে বলি—চল, সম্ভাব্য শ্যালিকাকে তার বাড়ি থেকে পাকড়াও করে নিয়ে আসি। কিন্তু পল তার গাড়ির চাবি খুঁজে পায় না। ঠিক তখনই এসে থামে বেজায় রকমের দীর্ঘ চেসিসের জমকালো একটি লিমোজিন। না, লিমোজিনে চড়ে কনে আসেনি, তবে তার এক সাবেক স্বামী লিমোজিনজাতীয় মস্ত গাড়িখানা পাঠিয়েছে তার পুনর্বার বিবাহে আমোদদানের উদ্দেশে। আমরা তাতে চাপতে চাপতে ভাবি, মেয়েটির বিবাহজাতীয় কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং সে হয়তো পলকে এবার একবারে ডোবাবে না।
কনের অ্যাপার্টমেন্টের ডোরবেল টিপতেই বেরিয়ে আসে মিনি স্কার্টের সঙ্গে মুখোশ পরা একটি মেয়ে। মনে হয়, মেয়েটির শরীর অ্যায়সা আকর্ষণীয় যে সে অজানা আগন্তুকদের মুখ দেখানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না। মুখোশিকা আমাদের জানায়, আরে, অধৈর্য হওয়ার তো কিছু নেই, তার বান্ধবী আগেও একাধিকবার বিয়ে করেছে। কথা যখন দিয়েছে, এবারও করবে। তবে কি না সে গেছে তার পাঁচ বছরের মেয়েকে তেসরা স্বামীর কাছে রেখে আসতে। আজ সকালে বেবিসিটার না আসায় যত গোল বেধেছে।
ফিরে এসে দেখি বোল্ডার সাজিয়ে তৈরি হূদয়ের নকশার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে ঝকমকে ব্রাইডাল গাউন পরা কনে। তার সঙ্গে এসেছে সাবেক দুজন স্বামী ও পাঁচ বছরের মেয়েটি। সে পলকে অজুহাত দিতে গিয়ে বলে, তৃতীয়বার যখন বিয়ে করি তখন অনেক খরচ করে এ গাউনটি তৈরি করেছিলাম। এখন তো রিসাইকেলের যুগ, তাই এ গাউনটি আবার ব্যবহার করছি; কিন্তু এটি এক্স হাজব্যান্ডের ওয়ার্ডরোবে খোঁজাখুঁজিতে অনেক সময় লেগে গেল, সরি। পাদ্রি তাড়া দেন। ঠিক তখনই বানরের মতো বাচ্চা মেয়েটি লাফ দিয়ে ঝুলে পড়ে পলের কাঁধে। নতুন বাবা পাওয়ার সম্ভাবনায় মেয়েটি স্পষ্টত খুশিতে বাগবাগ। পল ঝুলন্ত মেয়েকে নিয়ে কনের সামনে দাঁড়িয়ে সহসা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলে, তুমি কি সত্যি আমাকে বিয়ে করবে? আরে, কী মুশকিল! বিয়ে করতে জানি না নাকি? কাম ডাউন, হানি, শান্ত হও—বলে কনে পলের চাঁছা তালুতে হাত বুলিয়ে দিলে তার বন্ধুবান্ধব সাবেক সেনাদের অনেকের চোখেই অশ্রু দেখা যায়। মনে হয়, পকেটে করে ক্লিনেক্স নিয়ে এলে এদের খানিক হেল্প করা যেত। পাদ্রি তাঁর ঝুঁটি থেকে গোলাপ খুলে বিয়ে পড়ানোর উদ্যোগ নেন। কনে পলকে জড়িয়ে ধরে বলে, এ বিবাহে বাইবেলের ব্যবহার না করলে ভালো হয়, অতীতে বাইবেল পড়ে আমি অনেকবার বিয়ে করেছি, কোনোটাই জুতসই হয়নি। পাদ্রি জানান, এতে কোনো সমস্যা নেই, বিয়েটা দয়া করে দ্রুত করো, আমার তাড়া আছে, তারপর আমি না হয় ম্যাকব্যাথ থেকেই পড়ে শুনিয়ে দেব।
বিয়ের পর বর-কনের সঙ্গে বাচ্চা মেয়ে ও সাবেক দুজন স্বামীও এসে লিমোজিনে ওঠে। আমরা খানিক অস্বস্তি নিয়ে মুখোমুখি বসি। সদ্য স্বামী হওয়া পল আগেকার স্বামীদের দিকে না তাকানোর চেষ্টা করে। সবার গম্ভীর মুখ দেখে শ্যাম্পেনের ট্রে হাতে ড্রাইভার জানতে চায়, ইজ দিস অ্যা স্যাড অকেশন? আরে, দুঃখজনক ঘটনা হবে কেন?—বলে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত স্বামী কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়া ডিভোর্স দেওয়ার জন্য কনেকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলাস উঠিয়ে টোস্টের প্রস্তাব দেয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply