১৯৯০ সালে তীব্র গণ-আন্দোলন চলছে। দেশের সব পত্রপত্রিকা বন্ধ। এমনই সময়ে ভ্রমণ আয়োজক এক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হলো, তাদের অতিথি হয়ে জাপান থেকে বিখ্যাত এক অভিনেত্রী আসছেন, আমি চাইলে তার একটি সাক্ষাত্কার নিতে পারি। জাপানি তরুণদের বুক-ধড়াস এ অভিনেত্রীর বয়স মাত্র উনিশ—কিন্তু এরই মধ্যে তিনি হলিউডের তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। নাম ইয়োকি কুদোহ। ইউনেস্কো তাকে শুভেচ্ছা দূত নির্বাচন করেছে। টোপ গিললাম।
কিন্তু আগে কখনো কোনো অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার নিইনি। কী জিজ্ঞেস করা উচিত, সেটা জানার জন্য আমার প্রিয়ভাজন অভিনেত্রী তারানা হালিম ও নৃত্যশিল্পী তামান্না রহমানের কাছ থেকে কিছু টিপস নিলাম।
সাক্ষাৎকারের সময় এবং স্থান নির্বাচন করা হলো সন্ধ্যা সাতটায় শেরাটন হোটেলের লবিতে।
নির্দিষ্ট সময়ে ভ্রমণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মতিউর রহমান ও জাপানি ভাষা জানা বন্ধু যিশু তরফদারকে নিয়ে শেরাটনে উপস্থিত হলাম। শুনলাম কুদোহ সারাদিন কয়েকটি স্কুল ঘুরে খানিকক্ষণ আগে হোটেলে ফিরেছেন। তাঁর সেক্রেটারি মহিলা জানালেন, সাক্ষাৎকারে যদি তাঁর ছবি তুলি তাহলে আধাঘণ্টা লাগবে। ছবি না তুললে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবেন। আর সাক্ষাৎকার অবশ্যই আধাঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে।
জানালাম, ছবি তুলব, আধাঘণ্টা পরেই আসুন। আধাঘণ্টা পর সেক্রেটারি, দুজন মহিলা বডিগার্ডসহ কুদোহ এলেন। সাধারণ জাপানি মেয়েদের চেয়ে বেশ কিছুটা দীর্ঘছন্দের একহারা চেহারার প্রায় আয়ত চোখের অধিকারিণী ঈষৎ উন্নত নাকের অভিনেত্রীকে ঠিক জাপানি মনে হচ্ছিল না। কিন্তু সৌজন্যে পুরোপুরি জাপানি কেতা বজায় রাখলেন। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমেরিকান টানের ইংরেজিতে কথাবার্তা শুরু করলেন।
অভিনয়ে কী করে এলে—জিজ্ঞেস করলাম।
অভিনয় করব কখনো ভাবিনি। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে থাকতাম। টমবয় টাইপের ছিলাম। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করতাম। ভালোবাসতাম সাইকেল চালাতে আর সাঁতার কাটতে। স্কুলে ভালো ছাত্রী ছিলাম না—রূপকথার বই পেলে খুব পড়তাম। একদিন মাঠে কয়েকটি ছেলের সঙ্গে খেলছি, হঠাৎ একজন টেকোমাথার লোক আমাকে ডেকে বললেন, তুমি মডেল হবে? তাহলে এই ঠিকানায় আমাদের এজেন্সিতে চলে এসো।
ব্যাপারটি উড়িয়ে দিলাম। দিনকয় পর মনে হলো, একবার গিয়েই দেখি না কী হয়! গেলাম সেখানে। আমাকে হালকা মেকাপ দিয়ে একজন ক্যামেরাম্যান আমার প্রচুর ছবি তুলে কিছু ইয়েন ধরিয়ে দিলেন।
দিন তিনেক পর সেই টেকো বাড়িতে হাজির। আমাকে নাকি একটি বিজ্ঞাপনের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে আবার অনেক ছবি তোলা হলো। টাকাও পেলাম। পত্রপত্রিকায়, বিলবোর্ডে নিজেকে দেখে অবাক লাগল। এরপর একের পর এক বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন বিজ্ঞাপন করলাম। তারপর ছবির সুযোগ পেলাম। দুটি ছবি হিট করার পরই হলিউডে অফার পেলাম। কষ্ট করে ইংরেজিও শিখে নিলাম।
—এ জীবন কেমন উপভোগ করছ?
আমি হাঁফিয়ে উঠেছি, দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার কোনো প্রাইভেসি নেই। হয় শুটিং, নয় পার্টি। যেখানেই যাই, ক্যামেরা পেছনে তাড়িয়ে বেড়ায়।
—বয়ফ্রেন্ডকে সময় দিতে পার?
আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আমার মনে হয়, আমি কাউকে বুঝি না, নয়তো আমাকে কেউ বোঝে না।
—কী ধরনের ছবিতে অভিনয় করতে পছন্দ কর?
রোমান্টিক কমেডি, নয়তো সিরিওকমিক। অথচ জাপানের সাতটি টেলিভিশন চ্যানেলেই তুমি সেক্স, ভায়োলেন্সের প্রদর্শনী দেখতে পাবে। আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। অথচ করতে হয়…।
—এটা তো তোমার প্রফেশনাল অ্যাটিচুড হলো না।
আমি ভীষণ ক্লান্ত। তারপর সে যে কথাগুলো বলল সেগুলো খুব মন খারাপ করা। আমি বললাম, তোমার কি প্রায়ই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, চিরতরে?
হঠাৎ আমার হাত খামচে ধরে কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল, তুমি কী করে জানলে?
এ সময়ে কুদোহর সেক্রেটারি জানালেন, আধাঘণ্টা পার হয়ে গেছে। কুদোহ সেক্রেটারিকে অনুরোধ করে বলল, আমাকে একটু একা কথা বলতে দাও। তারপর অধৈর্যের মতো বলল—বলো, বলো, কী করে বুঝলে?
বললাম, পারফরমিং আর্টে যাঁরাই জনপ্রিয়তা পান, তাঁদের মনের মধ্যে একটা শূন্যতা কাজ করে। এত অল্প বয়সে আর স্পর্শকাতর মনে সেটা আরও চেপে বসে। আর তোমার অসামান্য জনপ্রিয়তা সেই শূন্যতাকে আরও বড় করে দিয়েছে। তার ওপর তোমাকে তোমার মনের বিরুদ্ধেও অনেক কাজ করতে হচ্ছে…।
সে কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে মুখের ভাব কিছুমাত্র পরিবর্তন না করে ঝরঝর করে চোখের জল ছেড়ে দিল। বলল, তোমাকে চিঠি লিখলে জবাব দেবে?
—ঠিকানা জানি না।
সেক্রেটারি কার্ড এগিয়ে দিলে কুদোহ ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিয়ে আমার হাত থেকে কাগজ-কলম ছিনিয়ে নিয়ে খসখস করে তার ঠিকানা লিখে দিল। কাতর কণ্ঠে বলল, কেন দেবে না? নিশ্চয়ই দেবে।
এরই মধ্যে কুদোহর বডিগার্ড কুদোহকে একরকম টেনে তুলে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। আমরাও এগিয়ে গেলাম। কুদোহ বোতাম টিপে লিফট আটকে রেখে ভেজা কণ্ঠে বলল, বলতে পার আমি কীভাবে বাঁচব? বললাম, তুমি যতটা পরিশ্রম করেছ, পেয়েছ তার লক্ষ গুণ। পরিশ্রমটা যদি বাড়াতে পার, তবে প্রাপ্তির কাছাকাছি এলে মনে শান্তি আসবে। তুমি বলেছ তোমার লেখার অভ্যাস আছে, চালিয়ে যাও, এটা তোমার বাঁচার সহায় হবে।
—কাল কি সন্ধ্যায় তোমার আর একবার সময় হবে?
আমি হাসলাম। লিফট চলতে শুরু করেছে। শেষ কথা শুনলাম, আমি বুঝে গেছি, তোমার সময় হবে না। তুমি আমাকে লিখবেও না। লিফট উঠে গেলে মতি ভাই, যিশু আমার দুই ডানা ধরে সিঁড়ির পথে এগিয়ে নিলেন। মতি ভাই পিঠ চাপড়ে বললেন, আরে তোমরা তো আর এক রোমান হলিডে তৈরি করতে যাচ্ছিলে।
অনেককাল পরে সুন্দরবনে একদল জাপানি পর্যটকের কাছে কুদোহর কথা জানতে চাচ্ছিলাম। তারা বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিল না কুদোহর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। একজন জানালেন, কুদোহর মা টোকিওতে বিরাট এক রেস্তোরাঁ দিয়েছেন, সেখানে পাখির মাংস পাওয়া যায়। আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয়, সত্যিই কি কুদোহর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply