মমর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই মামুনের গলাটা কাদার মতো হয়ে যায়। একেবারে থকথকে কাদা। অতি মোলায়েম, অতি গদগদ ভাব। এখনো সেই কাদা গলায় বিরাজ করছে। কিছুটা কাদা সে উগরে দিল এভাবে—তোমার দুটো নামই আমার খুব পছন্দ।
ফ্রাইড চিকেনের মোটকা, হাফ সাইজের একটা রানের মাথা টিস্যুপেপার দিয়ে ধরে আলতো করে কামড় দিল মম। আমার তো দুটো নাম। একটা হচ্ছে রেহনুমা তাবাসসুম, আরেকটা মম। কোনটা তোমার পছন্দ?
ওই তাবাসসুম মাবাসসুমটা না, আমার পছন্দ মম। মম অর্থ হচ্ছে অমর। নাম শুনেই বোঝা যায় তুমি অমর।
মুরগির ঠ্যাংয়ের কিছুটা গোশত দাঁত দিয়ে এমনভাবে ছাড়াল মম, যেন ঠোঁটের গাঢ় লিপস্টিকে মাখামাখি না হয়ে যায়। সেই অবস্থায়ই বলল, আমি তো তোমারই। আমি কি আর কারও?
না না, তুমি আর কারও হবে কেন? আমার বয়স একটু বেশি। তোমার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান অনেক…
মামুনের কথা শেষ হওয়ার আগেই মম বলল, এমন কিছু বয়স তোমার না। মাত্র তেতাল্লিশ। আমার হচ্ছে তেইশ। ব্যবধান বিশ বছর। এটা কোনো ব্যাপার না। আজকালকার আমার বয়সী মেয়েরা তোমাদের বয়সী পুরুষদেরই পছন্দ করে। কেন পছন্দ করে জানো, যাতে বরও ডাকা যায়, বাপও ডাকা যায়। আমেরিকায় তো টিনএজ মেয়েগুলো বুড়ো হাবড়াদের সঙ্গে প্রেম করে আর সারাক্ষণ তাদের ড্যাড ডাকে। হাবড়াগুলোর বেশির ভাগই বিবাহিত। এ ক্ষেত্রে তোমার একটা সুবিধা আছে। তুমি এখনো বিয়েই করোনি। তুমি অবিবাহিত।
অবিবাহিত কথাটা শুনে বুকটা ধক করে উঠল মামুনের। সেটা বুঝতে দিল না মমকে। মুখে কেলানো একটা হাসি ফুটিয়ে খানিক হে হে করল। তা তো বটেই, তা তো বটেই। অবিবাহিত, হে হে।
মুরগির ঠ্যাংয়ে আরেকটা কামড় দিল মম। এবারও ঠোঁট এবং লিপস্টিক বাঁচিয়ে। এই তোমাকে একটা তথ্য দিচ্ছি, শোনো। মেয়েরা লিপস্টিক ব্যবহার করে ঠিকই কিন্তু অপচয় করে কম। এই পৃথিবীতে বছরে সাড়ে ২৭ লাখ মেট্রিক টন লিপস্টিক উত্পাদিত হয়, তার মধ্যে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লিপস্টিক পুরুষেরা খেয়ে ফেলে।
শুনে মামুন মুগ্ধচোখে মমর দিকে তাকিয়ে সেই বেকুব হাসিটা হাসল। হে হে। বাহ্, অসাধারণ তথ্য। তোমাকে যত দেখি ততই ভালো লাগে আমার। তুমি এত সুন্দর। তোমার মতো সুন্দরী এই জীবনে আমি আর দেখিইনি। তোমার সামনে কিসের ঐশ্বরিয়া, কিসের প্রিয়াংকা।
মুখে কপট একটা ভঙ্গি করে মামুনের দিকে তাকাল মম। যাহ্, ওরা কত্ত সুন্দরী! তবে তুমি কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম। যেকোনো মেয়ে তোমাকে দেখলেই ‘তবে রে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তার ওপর অত্ত বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অত্ত বড় জব করো। তুমি একদম ‘জোছ’। বিবিএতে আমার লাস্ট সেমিস্টার চলছে। তার পরই তোমাকে আমি বিয়ে করে ফেলব। বরও ডাকব, বাপও ডাকব।
শুনে মামুনের কলিজাটা এবার মাত্র জবাই করা হয়েছে এমন মুরগির মতো একটা লাফ দিল। তবু মুখে সেই হে হে হাসিটা সে বজায় রাখল। হে হে।
মম বলল, কী, বিয়ে করবে না আমাকে?
ওই দেখো মেয়ে কী বলে? তোমাকে ছাড়া আর কাকে আমি বিয়ে করব বলো? তুমি হচ্ছো আমার ঐশ্বরিয়া, তুমি হচ্ছো আমার প্রিয়াংকা।
তাহলে আজ আমাকে ওই পান্নার সেটটা কিনে দাও না। মাত্র ৮৯ হাজার টাকা দাম। ওটা আমার খুবই পছন্দ। এক অ্যাস্ট্রোলেজার আমার হাত দেখে বলেছে, আঙুলে পান্নার আংটি আর গলায় মাঝেমধ্যে পান্নার নেকলেস পরলে, আমি যা চাইব তা-ই হবে। আমি তোমাকে চাই। ওই সেট মাঝেমধ্যে পরলে তোমাকে আমি পেয়ে যাব। আংটি তো সব সময়ই আমার আঙুলে থাকবে। আমি তোমার প্রেমে পড়লাম চার মাস হয়েছে। এই চার মাস তুমি আমাকে লাখখানেক টাকার জিনিস দিয়েছ। আর মাত্র ৮৯ হাজার টাকা! আজই কিনে দাও না, সোনা।
মামুনের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখে ওই হে হে হাসি। এমন করে বলার দরকার নেই। চলো এক্ষুনি কিনে দিচ্ছি।
কেএফসি থেকে বেরিয়ে সোজা গুলশান মার্কেট। ক্রেডিটকার্ড চার্জ করে পান্নার সেটটা মমকে কিনে দিল মামুন। কলিজাটা যদিও তার পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। প্রেমিকার চাহিদা বলে কথা।
পরদিন সকালে ঘটল আসল ঘটনা। আজ ছুটির দিন। মামুন একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। ঘুম ভেঙে দেখে স্ত্রী রেখা ব্যাগ-সুটকেস গোছাচ্ছে। পাশে পুতুলের মতো সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে মামুনের সাত বছরের মেয়ে মিষ্টি। ঘটনা কী?
মিষ্টি বলল, বাবা, আমরা নানুর বাড়ি চলে যাচ্ছি। মা, বলেছে এই বাড়িতে আর ফিরবে না।
মামুন রেখার দিকে তাকাল। রেখা একবারও তার দিকে তাকাচ্ছে না। মুখটা থমথমে।
মামুন কোনো রকমে বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে? কোথায় যাচ্ছ তুমি?
ককটেল ফাটার মতো এবার ফাটল রেখা। তোমার মতো লুচ্চার সংসার আমি করব না। সাত বছরের বাচ্চা থাকার পরও, আমার মতো বউ থাকার পরও তুমি একটা বাচ্চামেয়ের সঙ্গে লুচ্চামি করছ। তাকে বিয়ে করার কথা বলেছ। কাল তাকে ৮৯ হাজার টাকা দিয়ে পান্নার সেট কিনে দিয়েছ। এই যে দেখ, সেই মেয়ে আমাকে সব লিখে এসএমএস করেছে। আর এ পর্যন্ত তুমি তাকে যা যা দিয়েছ, সব একটা লোক দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।
নিজের মোবাইল অন করে এসএমএসটা মামুনের চোখের সামনে মেলে ধরল রেখা। পড়ো, পড়ো তুমি। আর এই যে মমকে যা যা দিয়েছ, সব এই প্যাকেটে আছে।
মামুন তখন জিন্দালাশ হয়ে গেছে। মম, মম এমন একটা কাজ করল! হায় হায়, এখন কী হবে?
এ সময় মামুনের মোবাইল বাজল। আনমনা ভঙ্গিতে ফোন ধরল সে। ওপাশ থেকে মমর গলা ভেসে এল। আপনার বউকে আমি সব জানিয়ে দিয়েছি, আপনার দেওয়া জিনিসগুলোও ফেরত পাঠিয়েছি। আপনার মতো লোকদের এভাবেই শিক্ষা দিতে হয়।
রেখা তার বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার ১০ দিন পর ডিভোর্স লেটার পেল মামুন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply