পাড়ায় একটা নতুন মেয়ে এসেছে। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিল। আশফাক আমাদের মধ্যে যোগ্যতম প্রেমিকপুরুষ, কারণ সে পাড়ার নাটকে হিরোর রোল করেছে। আর তা ছাড়া সে মেডিকেল কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ে। তার একটা প্রেম হলো না, এটা ওর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন, আমাদের জন্য প্রেস্টিজের ব্যাপার। পাড়ার নতুন মেয়েটার নাম বিউটি। সে দেখতেও যাকে বলে চলন্ত সৌন্দর্য। সে নাকি একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
আশফাক ওকে টার্গেট করল, ‘দোস্তো, এই পাখিটা আমার, তোরা কেউ অর দিকে তাকাইস না।’ আমরা মেনে নিলাম।
এখন মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় কী করে? কী করে তার বাড়ির অন্তঃপুরে আমাদের প্রবেশাধিকার তৈরি করা যায়? আমাদের মধ্যে নয়ন প্যাকেজ নাটক লেখার চেষ্টা করছে। পাড়ার নাটকটার সে-ই রচয়িতা। বিদেশি গল্প অবলম্বনে ওই নাটক রচনায় সে যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছিল। আমরা তাকেই দায়িত্ব দিলাম, ‘দোস্তো, তুই একটা স্ক্রিপ্ট লেখ, বিউটির সঙ্গে আশফাকরে কেমনে ভাঁজ খাওয়াইয়া দেওয়া যায়।’
স্ক্রিপ্ট রচিত হলো। বিউটি যখন ক্লাসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠবে, তখন শামীম, সাহান, বিমল তাকে ঘিরে ধরবে। বলবে, ‘কোথায় যাচ্ছ সুন্দরী। আমাদের ট্যাক্স দিয়ে যাও।’ তারা বিউটির মোবাইলটা কেড়ে নেবে।
মেয়েটি তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিত্কার করবে। অবধারিত। করতেই হবে। নায়ক আশফাক সেই সময় একটা শোলা দিয়ে বানানো ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে হাজির হবে। সে আক্রমণকারীদের বেদম প্রহার করবে। তারা তিনজনই আশফাকের পা ধরে মাফ চাইবে। ‘আশফাক ভাই, আপনে আমগো মাফ কইরা দেন।’ আশফাক ওদের লাথি মেরে ভাগিয়ে দেবে।
বিউটি বলবে, ‘আমার মোবাইল?’
আশফাক পরের দিন মোবাইল ফোন নিয়ে বিউটির বাসায় যাবে।
চমত্কার গল্প। আমরা সবাই উত্তেজিত। শোলা দিয়ে ব্যাটটা বানানো হয়েছে, যাকে বলে, জোশ।
মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে সুন্দরী বেরোল। সে রিকশা খুঁজছে তার বাসার সামনে। পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটু এগোল সে।
শামীম, সাহান, বিমল তাকে ঘিরে ধরল। ‘সুন্দরী, যা আছে দিয়ে দাও চটপট…’(ওরা সংলাপ ইম্প্রোভাইজ করেছে। বানাচ্ছে)
বিউটি মেয়েটা সত্যি সুন্দরী। জিন্স আর ফতুয়ায় তাকে মানিয়েছেও বেশ। হঠাত্ করে মেয়েটা কুংফুর মতো করে দুই হাত ভাঁজ করে ইয়া বলে চিত্কার করে উঠল। তার পা গিয়ে আঘাত করল শামীমের মুখে। শামীম ধপাস করে পড়ে গেল। দুই পা তুলে জোড়া লাথি বসিয়ে দিল বিউটি সাহানের বুকে। সেও কুপোকাত। বিমল দৌড় ধরল। মেয়েটি তাকে ল্যাং মারতেই সে ছয় ফুট গভীর খোলা নর্দমায় জরুরি অবতরণে বাধ্য হলো।
এই সময় নায়ক আশফাকের আবির্ভাব। সে বলল, ‘এত বড় সাহস, আমার পাড়ায় আইসা আমার ডারলিংয়ের গায়ে হাত তোলোস।’ বলে সে ব্যাট তুলে শামীম আর সাহানকে মারতে গেল। অমনি তন্বী তাকে ধরে পাঁজাকোলা করে নর্দমার পানিতে ছুড়ে মারল।
এরই মধ্যে পথচারীরা ঘিরে ধরেছে চারজনকে। তারা চার ছিনতাইকারীকে উত্তম-মধ্যম দেওয়া শুরু করল।
আশফাক বলল, ‘আমারে মারেন ক্যান। আমি তো অরে বাঁচাইতে গেছি।’
বিউটি বলল, ‘ওই, তুই আমারে ডারলিং কইছস কেন? আমি তোর ডারলিং হই?’
চারজনই পঙ্গু হাসপাতালে। স্ক্রিপ্ট রাইটার নয়নকে গালি দিলাম আমরা। ‘তোর জন্য এই রকম হইল।’ সে বলল, ‘আসলেই। ক্যারেক্টারাইজেশন ঠিক হয় নাই। নায়িকা যে কুংফু-কারাতের ব্ল্যাক বেল্ট, সেটা তো আমাকে আগেই জানাতে হতো।’
ড্রেনের পানিতে ভাসমান দুজনের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তাতে ছবি-পরিচিতি হিসেবে লেখা হয়েছিল, ‘প্রেমের মড়া জলে ডোবে না’।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply