ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে একটা রসাল লেখা লিখতে বলেছেন বিভাগীয় সম্পাদক। কাজটা কঠিন। আমি বলেছিলাম, ভ্যালেন্টাইন-সফল কাউকে বললেই তো ভালো; বিশেষ করে যার জীবনে কোনো ভ্যা-দিবস রসের রসদ জুগিয়েছে। সম্পাদক জানালেন, এক বছর আগের কোনো সফল ভ্যালেন্টাইনকেও দেখা গেছে বছর ঘুরতেই স্ত্রী/প্রেমিকার কাছে ভিলেন্টাইনে পরিণত হতে। প্রধানত, তার নির্বুদ্ধিতার জন্য। প্রেমিকপ্রবর হয়তো খেয়াল করেনি, প্রেম ও বিয়ে একটা বোঝাপড়ার নাম। এই বোঝাপড়ায় ছেলেটি সব সময় স্বীকার করে নেবে সে ভুল করেছে—কোনো ভুল না করলেও—এবং মেয়েটি সব সময় তার সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হবে। দুজন যদি একটা ব্যাপারে মতৈক্য পৌঁছাতে না পারে, তাহলে কিসের রসময় জীবন?
সম্পাদক যখন ধরে বসেছেন লেখা চাই, তখন তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম, ভ্যালেন্টাইন-দিবস নিয়ে তাঁর কোনো রসের কথা মনে পড়ে কি না; যদি পড়ে, তা দিয়েই চালিয়ে দেব, মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো। সম্পাদক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, ‘কোন দিবসের কথা বললেন, স্যার? শোক দিবস?’ আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমি দেখেছি, ভ্যা-দিবসটি শোক দিবসও কারও কারও কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ভ্যা-দিবসের প্রধান ভেন্যু। ক্রিকেটের যেমন মিরপুর, ফুটবলের বঙ্গবন্ধু, তেমনি ভ্যা দিবসের ঢাবি। দু-একজন ছেলেকে এখানে ভ্যা-ভ্যা করে কাঁদতেও দেখেছি। এ রকম একটি ছেলেকে দেখলাম সান্ত্বনা দিচ্ছেন আমার এক সহকর্মী। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, ছেলেটির প্রেমিকা আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছে যে ছেলেটি তাকে একটা সোনার আংটি দিয়েছে। সকালে এই স্বপ্নের মানে কী হতে পারে, মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করায় ছেলেটি বলেছে, ‘তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি নিউমার্কেট থেকে আসছি।’ কিছুক্ষণ পর ছেলেটি একটি প্যাকেট নিয়ে ফিরলে মেয়েটি হেসে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ছেলেটিও প্যাকেট খুলে তার হাতে কিছু একটা তুলে দেয়। মেয়েটি চোখ খুলে দেখে, খাবনামা। ছেলেটি বলেছে মেয়েটিকে, ‘স্বপ্নটার কী মানে, চলো দুজন মিলে খাবনামাটিতে দেখি।’
তার পরই অবশ্য ভ্যা!
বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইনস দিবস উদ্যাপনের ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক। আমার এক মার্কিন বন্ধু এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমরা কি তাহলে এত দিন প্রেমহীন জীবন কাটিয়েছ?’ আমি বললাম, ‘এ দিনটি আমাদের দেশে পালিত হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, আমেরিকা কীভাবে অপ্রেম ছড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। যত না ভ্যা-দিবস কার্ড, তার চেয়ে বেশি বোমা, তার চেয়ে বেশি বুলেট তোমরা পাঠাচ্ছ বিশ্বে। এখন বাংলাদেশ দায়িত্ব নিয়েছে, আমেরিকার অপ্রেমকে বিশ্বপ্রেমে রূপান্তর করার। প্রেমহীন জীবন কাটিয়েছি আমরা? ছোঃ। আমাদের সাহিত্যের এগারো বছরের নায়িকারা (শরচ্চন্দ-রবীন্দ্র দ্রষ্টব্য) যে প্রেমময় কথা বলেছে এক শ বছর আগে, তোমাদের পঁচিশ বছরের নায়িকারাও এখনো তা শেখেনি।’
অবশ্যই। এগারো বছরের মলিনা বলছে চল্লিশ বছরের সরোজবাবুকে, জ্যোছনা রাতে জানালার পাশে বসে, ‘ও গো, দেখো, আজ চাঁদটা শুধুই তোমার আর আমার। ওই চাঁদের ভেলায় ভেসে কি আমরা দুজন অনন্তের পথে চলে যেতে পারি না?’ সরোজবাবু অবশ্য বলেছে মলিনাকে, ‘জানালাটা বন্ধ করো। বড় ম্যালেরিয়া হচ্ছে দেশে। আর শোনো, এক ছিলিম তামাক সেজে আনো’… ইত্যাদি, কিন্তু তাতে কি! মলিনার এগারো বছরের মনে ভ্যা-দিবস তো সেই বহু আগেই সিল-ছাপ্পর মেরে দিয়েছে।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নিয়ে এক গল্প শোনাল আমার এক বন্ধু। পুরান ঢাকার একটা লক্কড়-ঝক্কড় বাড়ির মালিক সে। তার এক ভাড়াটের ছেলে বিশ্ব ভালো বাসা দিবসের পোস্টার এঁকেছে, কলেজে প্রদর্শনী হবে। ছেলেটির বাবা রক্ষণশীল মানুষ; তিনি পোস্টার দেখে ছেলেকে মারতে গেছেন। ছেলে বাবাকে থামিয়ে বলল, ‘রাগছ কেন, বাবা, আজ বসতি পরিষদের উদ্যোগে ‘বিশ্ব ভালো বাসা দিবস’। যে বাসায় আমরা থাকি, সেটা কোনো বাসা, নাকি কাকের বাসা? তুমি ভালো বাসা চাও না?’ আমার আরেক সহকর্মী বিশ্বজিত্-এর স্ত্রী দিনটি অন্যভাবে উদ্যাপন করে। তার কাছে এটি ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’। বিশ্বজিেক সংক্ষেপে অনেকে ‘বিশ্ব’ বলে ডাকে।
২. রস+আলোর সম্পাদকের কাছে সাহায্য না পেয়ে আমি মন্টু মামার দ্বারস্থ হলাম। অকৃতদার মানুষ, সত্তরে পা দিয়েছেন। তিনি অবশ্য বলেন, তিনি অকৃতদার নন, অক্রীতদাস। বিবাহিত পুুরুষদের তিনি ক্রীতদাস বলেই ভাবেন। আমার ফোন পেয়ে তিনি বললেন, এসব নিয়ে ভাবেন না। কারণ প্রেম ও বিয়ে—দুটিই জটিল রসায়ন। রসায়ন না হলে বিয়ের পাঁচ বছর পর স্বামীকে রাসায়নিক বর্জ্য বিবেচনা করে ফেলে দিতে উদ্যত হয় কেন মেয়েরা? তিনি তার এক বন্ধুর গল্প শোনালেন। ‘ওর কোনো কথায় স্ত্রী কান দেয় না বলে আমাকে অভিযোগ করার পর বলেছিলাম, “স্ত্রীদের কিছু শোনাতে হলে ঘুমের মধ্যে কথা বলার ভান করো। সেটি তারা কান খুলে শোনে।” তো, মূর্খটা সত্যি ঘুমিয়ে পড়ে কিছু একটা বলেছিল। তারপর তো গলাধাক্কা।’ বলে হা হা করে হাসলেন। মন্টু মামার বিবাহবিরোধী কথাবার্তা থামাতে আমি এবার প্রশ্ন করলাম, ‘মামা, বিয়ের সবটাই কেন নেতির দৃষ্টিতে দেখছেন, কোনো ইতি নেই?’ ‘ইতিই তো প্রধান হে,’ মামা আবারও জোরে হেসে বললেন, ‘ইতি ৮০! মনে নেই?’ ফোন রাখার আগে মামা বললেন, ‘শোনো, ইতির কথা যখন তুললে: বিয়ের প্রথম বছরে স্বামী যখন কথা বলে, স্ত্রী শোনে—এটি ইতিবাচক। দ্বিতীয় বছরে স্ত্রী কথা বলে স্বামী শোনে—এটি আরও ইতিবাচক। তৃতীয় বছরে দুজনই কথা বলতে থাকে আর প্রতিবেশীরা শোনে। সেখানেই আসল ইতি। হা হা।’
৩. ভ্যা-দিবসের রসের একটা ঘটনা ঘটেছিল আমার চোখের সামনে, দুই বছর আগে। টিউটোরিয়াল ক্লাস ছিল। দেখি, খুব সেজেগুজে ছেলেমেয়েরা এসেছে। এদিন সকালে মুঠোফোনে মেসেজ এলে সবাই সচকিত হয়। একটি মেয়ের ফোনে মেসেজ এল। সবাই কৌতূহল নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটিও আড়চোখে তার ফোনের দিকে তাকাল। ভ্যা-দিবসের ফোন-মেসেজ বলে কথা, স্যার সামনে বসা থাকুন আর না-ই থাকুন, দেখতে তো হবেই! হঠাত্ মেয়েটি জোরে হেসে উঠল। ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলে সলাজ কণ্ঠে মেয়েটি বলল, ‘স্যার, বাবার ভ্যালেন্টাইন মেসেজ, মায়ের জন্য। ভুলে আমার ফোনে পাঠিয়েছে।’
মেয়েটিকে বললাম, ‘তোমার বাবা দীর্ঘজীবী হবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply