মাহতাব ভাই আমার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েকের বড়। কিন্তু দেখতে যেমন দশাসই, তেমনি অসুরের মতো শক্তি গায়ে। আমাদের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন। লুজ বল পেলে চোখ বুজে ছক্কা মারেন। পোর্ট ক্লাবের মাঠটা তো ছোট, মাহতাব ভাইয়ের ছক্কার মারে সীমানা দেয়াল পেরিয়ে বল গিয়ে পড়ে সানিয়া মির্জাদের বাগানে। সানিয়া মির্জা কে? সে কথা পরে বলছি।
শুক্রবার ছুটির দিনে আমাদের ম্যাচ ঠিক হলো ‘তরুণ শক্তি’র সঙ্গে। মনে মনে খুব উত্তেজনা নিয়ে হাজির হয়েছি মাঠে। কিন্তু আমার সব উত্তেজনার মুখে পানি ঢেলে দিয়ে মাহতাব ভাই বললেন, ‘তুমি এক্সট্রা।’
‘মানে?’
‘মানে আবার কী, তুমি দ্বাদশ ব্যক্তি, দলের কেউ আহত হলে তোমাকে নামানো হবে।’
আমি এক্সট্রা? দ্বাদশ ব্যক্তি? পানির বোতল নিয়ে মাঠে নামা, কারও প্যাড বা গ্লাভস জুতসই না হলে বদলে দেওয়ার জন্য ছুটে যাওয়া—এসবই আমার কাজ? অপমানে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায় আমার। কিন্তু খেলার মাঠ বলে কথা, এখানে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ নিষিদ্ধ, তাই অনেক কষ্টে চোখের জল সংবরণ করি আমি।
মাহতাব ভাই বললেন, ‘এক্সট্রা মানে খারাপ কিছু নয়, শচীন টেন্ডুলকারের মতো ক্রিকেটার কতবার এক্সট্রা ছিলেন…।’
তাই নাকি, শচীন টেন্ডুলকারও ছিলেন? আমি শচীনের বর্তমান ক্যারিয়ার দেখে সান্ত্বনা খুঁজি।
খেলায় টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছে আমাদের ‘পোর্ট জুনিয়র ক্লাব’। মাত্র তৃতীয় ওভারেই আসল চেহারায় আবির্ভূত হলেন মাহতাব ভাই। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও শেষ বলে তিনটি ছক্কা। একটি তো দেয়াল পেরিয়ে সোজা সানিয়া মির্জাদের বাগানে। বরুণ বলল, ‘শুক্রবার ম্যাচ হলে মাহতাব ভাইকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ কথাটা ঠিক। কেন, শুক্রবার কেন? কারণ ছুটির দিন সানিয়া মির্জা এসে দাঁড়ায় ওদের দোতলা বাড়িটার ছাদে। মাহতাব ভাই বলেন, ‘সানিয়া আমার প্রেরণা।’ প্রতিটি ছক্কায় নাকি সানিয়া সবার অলক্ষ্যে ফ্লাইং কিস পাঠায় মাহতাব ভাইয়ের দিকে। খেলা শেষে ছোট ভাইকে দিয়ে নিজের বাগানের একটি গোলাপ পাঠিয়ে দেয়। এসব শুনে শচীনের বদলে জীবনে মাহতাব ভাই হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি আমি।
ওর আসল নামটা আমরা কেউ জানি না। মাহতাব ভাই জানেন, কাউকে বলেন না। সব সময় টপ আর স্কার্ট পরে থাকা এ মেয়েটিকে ভারতীয় টেনিস-তারকা সানিয়া মির্জার মতো দেখায় বলে ও সানিয়া মির্জা। নামটা কে দিয়েছিল কে জানে।
শেষ বলে ছয় মেরে ইনিংস শেষ করেছিলেন অপরাজিত ৮০ রান করা মাহতাব ভাই। আমি সেই বল আনতে দেয়াল টপকে ঢুকেছি সানিয়াদের বাগানে। শিউলি-বেলি-জবা-লেবুগাছের ঝোপে-ঝাড়ে উবু হয়ে বল খুঁজছি। হঠাত্ মিষ্টি একটা গলা শুনতে পেলাম, ‘এই যে, বল এখানে।’
ঘুরে তাকিয়ে দেখি জুঁই ফুলের মতো হাসিতে মুখ ভরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সানিয়া মির্জা। লাল স্কার্ট আর বল প্রিন্টের টপ পরা মেয়েটাকে কখনো এত কাছ থেকে দেখিনি। এ তো দেখি সত্যিকার সানিয়ার চেয়েও সুন্দরী। চোখে চোখ পড়তে বলল, ‘আসিফ ভাই, কেমন আছেন?’
‘আমাকে…মানে আমাকে আপনি চেনেন?’
‘চিনব না কেন? আপনি মুন্নির ভাই, সিটি কলেজে পড়েন, মুন্নি আমার বন্ধু তো, ক্লাসমেট, আপনাদের বাসায় কত গেছি, আপনি গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছেন এসএসসিতে, তখন খালাম্মা মিষ্টি খাইয়েছিলেন…।’
‘আপনি মুন্নির বন্ধু?’
‘আপনি বলছেন কেন, আসিফ ভাই, আমি ছোট না?’
‘হ্যাঁ, তাই তো…তোমার কথাও আমি অনেক শুনেছি…তুমি তো সানিয়া মির্জা, আমাদের মাহতাব ভাইয়ের ইয়ে…।’
‘সানিয়া মির্জা কে? আমি তো তানিয়া, সবাই ডাকে তানি।’
‘সরি, সানিয়া না, মানে তুমি সানিয়ার মতো, টেনিস তারকা সানিয়া মির্জার নাম শোননি?’
ঠোঁট উল্টে তানিয়া বলল, ‘না।’ শুনে অবাক হইনি। সুন্দরীরা গাধা হয়—এটা আমি জানি।
তানিয়া আবার বলল, ‘কিন্তু মাহতাব ভাইয়ের ইয়ে মানে কী?’
আমি সসংকোচে বলি, ‘মানে যাঁর জন্য তুমি ছাদে এসে দাঁড়াও,…খেলা দেখতে দাঁড়িয়ে থাক…।’
ভ্রু কুঁচকে তানি বলল, ‘আমি ছাদে দাঁড়াই মাহতাব ভাইয়ের জন্য? মাহতাব ভাইটা আবার কে?’
আমি সিঁড়ির দু-তিন ধাপ উঠে দূর থেকে মাহতাব ভাইকে দেখাই। তানিয়ার মুখটা শক্ত হয়ে আসে, বলে, ‘ও, ওই গাড়লটা? স্কুলে যাওয়ার সময় আমাদের গেটের পাশে ঘুরঘুর করে যে স্টুপিডটা?’
ওর রাগী মুখ দেখে আমার ভয় হয়। আমি বলতে পারি না, তুমি ওকে ফ্লাইং কিস…বাগানের গোলাপ…।
ওর হাত থেকে বলটা নিয়ে কোনোমতে দেয়াল টপকাতে যাব, তখনই সানিয়া বলল, ‘আসিফ ভাই, আমি তো ছাদে যাই তোমাকে দেখব বলে…।’
কী! আমি কি ঠিক শুনলাম? ঘুরে তাকাতেই দেখি, অদ্ভুত একটা চাহনি দিয়ে ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটি। আশ্চর্য! আমি তো ছক্কা মারতে পারি না, আমাকে কেন?
মাঠে যখন ফিরলাম তখন নতুন বলে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে। পটাপট উইকেট পড়ছে, জয় আমাদের নিশ্চিত। কিন্তু এসব তখন আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি তো মাঠে না নেমেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। মাথার ভেতর সানিয়া মির্জার শেষ কথাটা, চোখ বুজলেই অদ্ভুত সেই চাহনি।
পরদিন থেকে মাঠে এসে প্রথমেই বলে ফেলি, ‘শরীর ভালো লাগছে না, আমি এক্সট্রা।’
মাহতাব ভাই একের পর এক ছক্কা মারেন, আমি বল কুড়োতে দেয়াল টপকাই। কুড়োতে হয় না, আগেভাগেই বল হাতে একগাল জুঁই ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সানিয়া, মানে তানিয়া।
একদিন বলল, ‘কাল স্কুলের আগে রেইনবোর সামনে এসো, আসিফ ভাই, আইসক্রিম খাওয়াব। আসবে?’
আসব না মানে!
পরদিন সকালে ফিটফাট হয়ে যাত্রা করেছি রেইনবোর উদ্দেশে। রিকশায় ওঠার মুখে মাহতাব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি, মাহতাব ভাই।’
‘ম্যাচ কোথায়?’ মহাবিস্ময় মাহতাব ভাইয়ের কণ্ঠে, ‘আমাকে নিবি না?’
‘নিতে পারি, কিন্তু এই ম্যাচে তো তুমি এক্সট্রা।’
রিকশা তখন চলতে শুরু করেছে। মাহতাব ভাইয়ের মুখটা দেখতে কেমন হয়েছে দেখার সুযোগ পেলাম না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৮, ২০১০
Leave a Reply