অমিয়ভূষণ মজুমদার একবার বলেছিলেন, ইতিহাস হচ্ছে রোমান্টিকতার খনি। তিনি হয়তো ইতিহাসে, এক নির্মিত সময়ের গর্ভে, ব্যক্তিনিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা দেখেছিলেন। তা-ই যদি হয়, আরও একটু দূর এগিয়ে আমরা আরেকটি প্রশ্নের সুলুকসন্ধান করতে পারি—কীভাবে ছোটগল্পের সময় সেই ইতিহাসের সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়? আমাদের কোনো একটি আশ্চর্য সবুজ ভোরবেলাকে ইতিহাস নিশ্চয়ই খুঁজে পায় না, যেই ভোরে অকস্মাত্ সূর্যের আলো এসে প্রবেশ করে প্রাণের ওপর। হয়তো ছোট একটি নদী বা আত্মঘাতী কিছু মানুষের করুণ মৃত্যুকেও মনে রাখে না ইতিহাস। আসলে ইতিহাসের সময় কী দিয়ে নির্ধারিত হয়? কে নির্ধারণ করে? এসব প্রশ্ন সামনে আসবে। তবে গড়পরতা বিবেচনায় যেসব ঘটনা আর অভিজ্ঞতা কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর ব্যাপকসংখ্যক মানুষের জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে, তা-ই নির্ধারণ করে ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসযান কি সবকিছুকে নেয়? ক্ষমতা আর ক্ষমতা সম্পর্কিত বিশ্বাস তার উপাদানগুলোর অনিবার্যতা বা তুচ্ছতাকে পরিমাপ করে। কত না কাল ধরে কত ছোট ছোট সময়ের পকেট থেকে কত জীবনই তো হারিয়ে গেছে, মানুষের ইতিহাস তার খোঁজ পায়নি। হয়তো সেসবের খোঁজ থাকে মানুষের কাছে নয়, ফড়িংয়ের কিংবা দোয়েলের কাছে।
ছোটগল্প বা ফিকশনের রচয়িতা যেভাবে সময়কে তুলে আনেন, তাতে ওই সময়ের সঙ্গে ইতিহাসের সময়ের সম্পর্ক ধরা পড়ে যায়। এটা আখ্যান রচয়িতার দায়ও বটে। না হলে নশ্বর মুহূর্ত আর ঘটনাগুলোকে তিনি দাঁড় করাবেন কোথায়?
তাহলে গল্প বা আখ্যান কীভাবে বা কী কাজ করছে পাঠকের ওপর? রচয়িতার কাজ কি কেবল দেখিয়ে দেওয়া? তাঁর অভিপ্রায় আর রুচি এমন একটি আঙ্গিককে খুঁজে নেয়, যা তাঁর অভিজ্ঞতাকে আকার দেয় টেনে ধরা একটি ধনুকের ছিলার মতো, তীরকে যা যুক্ত করে ভবিষ্যতের সঙ্গে। পাঠক নিজের মুহূর্ত, তাঁর অভিজ্ঞতার ঘটনাবলিকে নিয়ে রচয়িতার সঙ্গে গল্পের সময়কে যাপন করেন। দুজনেরই অভিমুখ ধনুকের তীর যে ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান, সেই দিকে। এভাবে রচয়িতা আর পাঠক পরস্পরের সঙ্গে আত্মীয়তা করেন।
আমরা যে সময়কে যাপন করি, অভিজ্ঞতার তুল্যে তার সব মুহূর্তের ওজন একই রকমের নয়। আবার সময় বস্তুনিষ্ঠ হলেও একই প্রসঙ্গ-কাঠামোর ভেতর থাকা মানুষ কোনো একটি মুহূর্তকেও একইভাবে দেখে না। আর আখ্যান রচয়িতার কাছে তো অতিচেনা ঘটনা বা মুহূর্তটিও অচেনা, কারণ তাতে তিনি অভাবনীয়ের খোঁজ করেন। পারভেজ হোসেনের অনেক গল্পই একেকটি কেন্দ্রীয় ঘটনাবিন্দু বা মুহূর্তের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে তৈরি হয়। যেমন ‘চিরুনি তালাশ’ গল্পটি এগিয়ে গেছে সেই মোক্ষম মুহূর্তটির দিকে, যখন মুনতাসির অকস্মাত্ কোমর থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে রফিকের থুতনির নিচের নরম মাংসে ঠেকাবে। কিংবা ‘আঁধার’ গল্পের শিশু-জন্মের মুহূর্তটি, যা পাঠকের শ্বাস রোধ করে প্রলম্বিত হতে থাকে গল্পে বা ‘সিদ্ধান্ত’ গল্পে আনুর বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তটি যখন মনের ভেতর ফিরে আসে তার বিয়ের রাতটি, আনুর গায়ে জ্বর থাকা সত্ত্বেও আদনান যখন চড়াও হয়েছিল তার ওপর। ‘অশুভ প্রেরণার উেস’ গল্পেও আছে একটি কেন্দ্রীয় অনুভব, যা খালেককে ক্রোধে উন্মত্ত করে এবং সে চাপাতি চালায় প্রেমিকার শরীরে। গল্পগুলোর আণুবীক্ষণিক মুহূর্ত, ঘটনা বা অনুভবগুলো নিজের নিজের ঘেরাটোপে অনন্য নয়। এদের গভীরতা সৃষ্টি হয় অন্য সব মুহূর্ত, ঘটনা বা অনুভবের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার ভেতর দিয়ে। ‘চিরুনি তালাশ’ গল্পের খুব সাধারণ ত্রাসের একটি মুহূর্ত মহাকাব্যিক মুহূর্তের উচ্চতা পেয়ে যায় যখন আমরা দেখি, রফিক সরকারি বাহিনীতে যাওয়ার আগে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার সময় মুনতাসিরের মামাকে খুন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল, আর মুনতাসিরকেও বাঁচানোর প্রশ্নেই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জল-কাদা পাড়ি দিয়ে ঘাড়ে ও নৌকায় করে নিয়ে যাচ্ছিল শহরের দিকে। এই আহত মুনতাসিরের হাতে রফিকের নিজের খুন হওয়ার মুহূর্তটি পাঠককে এমন এক সীমানায় দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখান থেকে দুই বিপরীতকে একই রকম দেখায়।
গল্প রচনায় পারভেজ হোসেনের ধাঁচ রিয়ালিস্টিক। যুক্তিবোধের শাসন মেনে, বাস্তবতার সীমাকে সমীহ করে তিনি গল্পের শরীর রচনা করেন। তাঁর সৃষ্টিশীল কল্পনা তাই অবাধ নয়। তিনি সেই সব গল্প রচয়িতার কাতারে নিজেকে শামিল করেন, যাদের পা সব সময় মাটি স্পর্শ করে থাকে।
আমাদের নিজেদের চারপাশে যে লোকগুলোকে সচরাচর আমরা দেখি, যদিও সব সময় খুব গভীর মনোযোগী হয়ে নয়, তারাই আসে তাঁর গল্পে। বাঁচার জন্য, জীবনের জন্য লড়াই করা মানুষ, প্রতারিত মানুষ, বিশ্বাসী মানুষ, ক্রোধান্ধ আর অসহায় মানুষ যারা নানা কায়দায় লড়াই করে বাঁচে। বাস্তবে যাদের মুখের দিকে, বাঁচার অভিজ্ঞতার দিকে আমরা ভালো করে দেখি না, গল্পে তাদেরই আমরা অনুভব করি, এই কৃতিত্ব গল্পকারের।
পারভেজ হোসেনের গল্পের দৃশ্যপট ফটোগ্রাফিক। তবে তিনি কোন তল থেকে বাস্তবতাকে দেখেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই তাঁর স্বাতন্ত্রকে বুঝতে সাহায্য করে। তাঁর গল্পের অনুপুঙ্খ ডিটেইল দৃশ্যকে অনুভবগ্রাহ্য করে তোলে আর বর্ণনার সজীব ও ঋজু ভাবটি পাঠককে শেষ অবধি পার করে নেয় অনায়াসে।
বিষয়, নির্মাণ ও শিল্পকৌশলের বিবেচনায় গ্রন্থের ‘চিরুনি তালাশ’, ‘আঁধার’ এবং ‘জোড়াদুল ও এক চোরের স্বীকারোক্তি’—এই তিনটি গল্পকে অন্যগুলোর থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করেছি, ‘চিরুনি তালাশ’ গল্পটিতে এসেছে এমন একটি এপিক মুহূর্ত, যা হয়তো অনিবার্যভাবে গেঁথে থাকে আমাদের শরীরের মাংসের ভেতর অথবা সেই স্ববিরোধের ভেতর, যা আমাদের ছিন্নভিন্ন করে, আমাদের বেঁধে রাখে স্বর্গ ও নরকের মাঝখানে কিংবা যেখানে সত্য আর মিথ্যা জায়গা বদল করে পরস্পরের। ‘আঁধার’ গল্পে এক গর্ভিনীর জঠর থেকে শিশু-জন্মের প্রলম্বিত যে সময়কে বর্ণনা করা হয়েছে, তা পাঠককে উসকে দেয়, অস্বস্তিতে ফেলে এবং এলিয়েনেট করে। জন্মের আগেই অসহনীয় আর যুদ্ধপ্রায় পরিস্থিতির শিকার হওয়া শিশুটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় মিথিক সেই শিশুদের কথা, দেবতারা যাদের জন্মকে শাসন করেন, দণ্ডিত যারা জন্মের আগে থেকেই। ‘জোড়াদুল ও এক চোরের স্বীকারোক্তি’ গল্পে মতি চোরের বঞ্চনা, ব্যর্থতা, দারিদ্র্য আর প্রতিশোধ একসঙ্গে একই সুরে গ্রথিত হয়েছে নিজেরই উপহার দেওয়া একজোড়া কানের দুলের চুরি মারফত নিজের হাতে ফিরে আসার ভেতর দিয়ে। এ গল্পগুলোকে পাঠক মনে রাখবেন, এমন প্রত্যাশা নির্দ্বিধায় করা যায়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply