সালটা ‘উনিশ শ ছোটবেলা’। সিলেটে একদিন আমাদের বাড়ির গেটে আমারই নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়। তাতে সিদ্ধান্ত হয়, পাশের শত্রুপাড়া ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে আমরা একটি প্রীতি ম্যাচ খেলব। কিন্তু আমাদের লজিসটিকসের বিপজ্জনক ঘাটতি আছে। একখানা মাত্র জীর্ণ পুরাতন ব্যাট। হার্ড দু-চার ঘা খেলে ম্যাচের দিনই হয়তো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কাঠের বলটা ভিজে পচে গেছে। শট মারলে ফচ করে শব্দ হয়। বিপক্ষ দলের মালপত্রেরও ওই প্রায় একই অবস্থা। এদিকে আমাদের তহবিলে রয়েছে পরিষ্কার একটি গোল্লা। অগত্যা আমরা গেলাম পাড়ার সোহবত্ আলী মিরাশদার চাচার কাছে। চল্লিশ বছর ওমানে ছিলেন। টাকা কামিয়ে ক্লান্ত। শুনেছিলাম অল্পবয়সে তিনি ক্রিকেট খেলতেন। তাই ভাবলাম আমাদের প্রতি নিশ্চয়ই তাঁর কিছু দয়ামায়া থাকবে। আমাদের ব্যাট-বল দেখে সোহবত্ চাচা কিছুক্ষণ খ্যাক-খ্যাক করে হাসলেও নতুন সরঞ্জাম কিনে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমার উম্মর এখন ষাইট। তোদের বয়সে কিরকেট আমিও থুড়া-বহুত খেলাইছি। আইচ্ছা, যা, তোদের খেলায় আমিও থাকমুনে।’ শুনে আমরা উত্সাহিত বোধ করলাম। তবে চাচার কথার প্রকৃত অর্থ বোধগম্য হলো পরে।
অবশেষে ম্যাচের দিন এল। দুইপক্ষই মাঠে হাজির। পাড়ার শিক্ষিত বেকার রোগা-পটকা সল্লু ভাই ইস্তিরিবিহীন কালো একটা কোট পরে মাথায় শোলার হ্যাট চাপিয়ে আম্পায়ার সেজেছেন। এমন সময়, মাঠের কাছেই বাসা, অথচ গাড়ি দিয়ে এসে নামলেন সোহবত্ চাচা। কিন্তু এ কী! চাচার পরনে গোলাপি কোর্তা, সাদা সালোয়ার। পায়ে সাদা কেডস, চোখে সবুজ সানগ্লাস। চাচা এসেই বললেন—‘কই, ব্যাটখান দেখি। শক্ত দেইখা কিনছস তো?’ পরক্ষণেই বিপক্ষ দলের উদ্দেশে হাঁক ছেড়ে বললেন—‘অই ছ্যামড়ারা, যা তোরা ফিল্ডিং-এ নাম গা। টস-মস আর করার দরকার নাই। আমরার ব্যাটিং আগে। আমি ওপেনার। একটা সেঞ্চুরি মাইরা যামুগা।’ আমাকে ডেকে বললেন—‘তুই আয়, আমার রানার। তোর ঠ্যাং দুইটা লাম্বা আছে।’ এভাবেই ক্রিকেটের যাবতীয় আইন-কানুন-কালচারকে কাঁচকলা দেখিয়ে শুরু হয়ে গেল আমাদের প্রীতি ম্যাচ। বিপক্ষের হায়ার করা জোয়ান বোলার চাচাকে প্রচণ্ড একটা বাউন্সার ছুড়ল প্রথমেই। চাচা ‘হেঁইয়ো’ বলে বেপরোয়া ব্যাট হাঁকড়ালেন। ব্যাটে-বলে হলো তো না-ই, উপরন্তু চাচার হাত ফসকে ব্যাট উড়ে গেল একদিকে। ব্যালান্স হারিয়ে চাচা নিজেও উল্টে পড়লেন পিচের ওপর।
পরের বলটা চাচার অফ স্টাম্পখানাই উড়িয়ে নিয়ে গেল। জোর আপিল হলো। আম্পায়ার ওপরে আঙুল তুলে আউটের রায় দিলেন। চাচা খেপে উঠে বললেন—‘নো নো! নট আউট! ওইটা নো বল আছিল। আমি নিজের চউখে দেখছি। চোর কোনখানের!’
বোলারকে বললেন, ‘অই মিয়া, খাড়াইয়া দাঁত বার কইরা হাসো কেনে? যাও, আপনা কাম করো!’ জেদি বুড়োর কাছে সবাই হার মানল। কিন্তু তৃতীয় বলে চাচা হিট উইকেট হয়ে গেলেন। অর্থাত্ নিজেই ব্যাট চালিয়ে নিজের উইকেট ভেঙে দিলেন। অবশ্য এবারে চাচা খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখিয়ে বললেন, ‘ব্যাড লাক।’
ফিরে এলেন তিনি মাঠ থেকে। যাওয়ার সময় নিজ দলের সদস্যদের বলে গেলেন, ‘তোরা ব্যাট-বল সব পিটাইয়া ভাইংগা ফালা। আমি নতুন কিইন্যা দিমুনে। জিতন চাই।’ তারপর বললেন, ‘তোরা শোন। এই খেলার খবর আমি সাপ্তাহিক নীরস বার্তায় ছাপানোর বন্দোবস্ত করতাছি। হেই পত্রিকার সম্পাদক ব্যাটা আমার বেয়াই লাগইন। নো ফ্রবলেম।’ না বলাই ভালো, খেলায় আমরা হারলাম।
তার চেয়েও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল দুই দিন পর যখন আমাদের খেলার খবর ওই পত্রিকায় বের হলো। খবরটির উল্লেখযোগ্য অংশটি হচ্ছে এ রকম, ‘ওমান প্রত্যাগত সিলেটের ক্রীড়া-শার্দূল বর্ষীয়ান ক্রিকেট খেলোয়াড় সোহবত্ আলী মিরাশদারের অপরাজিত ১০০ রান সত্ত্বেও…’
কাওসার আহমেদ চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০১০
Leave a Reply