ইদানীং ক্যানটিনের মামুনও আমাদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না, শনিবারে তাঁকে তো পাওয়া যায়ই না, উপরন্তু তাঁর বিস্কুটের টিনও থাকে খালি। এর কোনো মানে হয়? চিনিবিহীন চা না খেলে আইডিয়া আসবে কী করে?
শনির দশা মানেই বিপদ। রস+আলোর মিটিংও হয় শনিবারে। চারটায় এই মিটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, আজ পর্যন্ত কোনোদিন তা চারটায় শুরু হয়নি। এ সময় আমরা মিটিংয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ মামুনের ক্যান্টিনের চিনিবিহীন চা আর বিস্কুট খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কথিত আছে, এই চা-বিস্কুটের লোভেই নাকি আমরা দূর থেকে ছুটে আসি। তবে ইদানীং মামুনও আমাদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না, শনিবারে তাঁকে তো পাওয়া যায়ই না, উপরন্তু তাঁর বিস্কুটের টিনও থাকে খালি। এর কোনো মানে হয়? চিনিবিহীন চা না খেলে আইডিয়া আসবে কী করে?
রস+আলো কার্যালয়ে এসে আমরা কাজের চেয়ে আড্ডায় এত মনোযোগী হয়ে উঠি যে আশপাশের কিছুই আমাদের খেয়াল থাকে না। একবার ফুল ভলিউমে আড্ডা দিচ্ছি। এদিকে পুরো অফিসে বেজে উঠেছে ফায়ার অ্যালার্ম। সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের কোনো খবর নেই।
দরজা বন্ধ করে আমরা কথা বলতে থাকি (মতান্তরে চেঁচাতে থাকি), হঠাত্ দরজা খুলে কেউ ঢুকলেই আমরা চুপ! তবে সিমু ভাইয়ের আগমন টের পেলেই আমরা আইনস্টাইনের মতো গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসে যাই। কদিন আগেও আমরা সকালে আসতাম, সারা দিন বসে থেকেও কোনো আইডিয়া পেতাম না। কিন্তু পাঁচটা বাজলেই কীভাবে যেন সবার মাথায় আইডিয়া অটো চলে আসত। অবস্থা এমন যে কাগজ-কলম নিয়ে আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম পাঁচটা বাজার জন্য। আর পাঁচটা বাজলেই কেল্লাফতে!। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর কী যে হলো! এখন পাঁচটা বাজলেই ঘুম আসে।
রস+আলো বাহিনীর প্রায় সবাই ফাঁকিবাজ টাইপের ছাত্র। এই তালিকায় সবার আগে আমার স্থান। এর পরেই আছে মহিতুল আলম। মিরপুরের বাংলা কলেজে ইংরেজিতে পড়ে সে। কিন্তু কলেজে সে তার ক্লাসরুমটা চেনে কি না তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। কামরুল হাসান আগে নিয়মিত থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তার মনে কী যে দোলা লাগল (বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয় আর কি), তাকে আর দেখাই যায় না। এদিকে রাকিব কিশোর চার ঘণ্টার পরীক্ষা, দুই ঘণ্টা পর খাতা জমা দিয়ে বাইরে থেকে পরোটা-ডিম খেয়ে আবার হলে যান! কার্টুনিস্ট ও আইডিয়াবাজ মহিউদ্দিন কাউসার চিকিত্সাবিজ্ঞানের ছাত্র। কলম পেলেই আঁকা শুরু করেন (বিশিষ্ট বলপয়েন্ট কার্টুনিস্ট)। আমরা নিশ্চিত, তিনি ডাক্তার হলে প্রেসক্রিপশন দেবেন কার্টুনের মাধ্যমে। বলা যায় না, অপারেশন করতে গিয়ে রোগীর পেটের ওপর দুই-একটা কার্টুনও এঁকে ফেলতে পারেন! একমাত্র ব্যতিক্রম মেহেদী মাহমুদ আকন্দ। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুতেই তিনি তেমন আগ্রহী নন। কোনো পরীক্ষার দুই-তিন মাস আগে থেকেই তিনি বাসায় বন্দী হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। পরীক্ষার আগে তাঁকে কেউ রস+আলো কার্যালয়ে দেখেছে এ কথা শোনা যায়নি। এমনকি ভূমিকম্পের সময়ও আন্টি যখন তাঁকে বললেন, ‘মেহেদী, ভূমিকম্প হচ্ছে রে! বের হ!’ তখনো তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা যাও, আমার পড়া আছে। ম্যাক্রো ইকোনমিকসটা পড়ে ভাজা ভাজা করে ফেলতে হবে!’ তবে ছাত্র হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে একেবারে শিক্ষক হয়ে বেরিয়েছেন শাত শামীম। সারা জীবন স্যারদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তিনি নিজেই এখন স্যার হয়ে বসে আছেন। দুনিয়া বড়ই রহস্যময়! যেকোনো স্থানে যেকোনো অবস্থায় ঘুমাতে পারার গুণ নিয়ে জন্মেছেন তাওহিদ মিলটন। জানালা বন্ধ থাকলেও আমাদের মৃদু চিত্কারেই কাকপক্ষী ভয়ে পালায়, কিন্তু তিনি চেয়ারে বসেই নাক ডাকতে থাকেন। মহিউদ্দিন কাউসার আবার সম্পূর্ণ বিপরীত। বিটিভি দেখলেও তাঁর ঘুম আসে না।
যেকোনো কাজে সবচেয়ে উত্সাহী ছিল সৈয়দ রাকিব (ব্যানার রাকিব। এখন ব্যাংকার)। রস+আলো টিম কোথাও ঘুরতে যাবে, রাকিবের প্রথম এবং একমাত্র প্রস্তাব, চলেন তার আগে একটা ব্যানার বানাই। ট্রাকের সামনে সেই ব্যানার লাগিয়ে ট্রাকে করে কোথাও ঘুরতে যাই। মিটিংয়ে না এসে বুধবার সন্ধ্যার দিকে হেলতে দুলতে দেবদাস মার্কা একটা লুক নিয়ে আসেন কার্টুনিস্ট সাদাত ভাই। এসেই সিমু ভাইয়ের সঙ্গে গোপনে কী জানি মিটিং করেন তারপর চলে যান।
মিটিংয়ে মহিতুল আলম আগে আমাদের আইডিয়াগুলো লিপিবদ্ধ করত (এ জন্যই বোধ হয় সে এখন বিজ্ঞাপনী সংস্থার কপিরাইটার)। কিন্তু হঠাত্ সে বিদ্রোহী হয়ে লেখা ছেড়ে হাতে তুলে নিল কিবোর্ড আর মাউস। এখন সে ফেসবুকের স্ট্যাটাস আর কমেন্ট ছাড়া তেমন কিছু লেখে না। আর পুণ্যভূমি সিলেটে গিয়ে মাসুদুল হকের কী হলো কে জানে, সে এখন ব্লগের উচ্চমার্গীয় বিতর্কে এত ব্যস্ত যে ফান আর তাকে টানে না। আরও আছেন বিশ্বের সবচেয়ে মিতব্যয়ী কার্টুনিস্ট সাদিয়া আহমেদ। এক ঘর বা দুই ঘরের বেশি কার্টুন তিনি কখনোই আঁকেন না। আরেক কার্টুনিস্ট মাহফুজ রনী বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলো কীভাবে যেন আগেই টের পেয়ে যান এবং অন্তিম মুহূর্তে মোবাইল বন্ধ রাখাটাকে কর্তব্য বলে মনে করেন। ঘটনার দু দিন পর বলেন, ‘মোবাইল অফ রাখার জন্য আমি দুঃখিত। আর হবে না, প্রমিজ!’
এবার বলি সিমু নাসেরের কথা। তাঁর মতো ভালো মানুষই হয় না। তিনি নিজে না লিখে আমাদের লেখার যে সুযোগ করে দিয়েছেন, তা ইতিহাসে বিরল! তিনি বি.স মানুষ। চাইলে তো পুরো ২৪ পৃষ্ঠা একাই লিখতে পারেন। কিন্তু ক্ষমতার দাপট তিনি দেখান না (হেহেহেহে)। তিনি আধুনিক, সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে, তাঁর ১০ মিনিট মানে আমাদের ৩০ মিনিট! তাই তো মিটিংগুলো চারটার বদলে আধাঘণ্টা করে পেছাতে পেছাতে ছয়টায় গিয়ে ঠেকে। প্রথম আলো অফিসের দোতলার গ্রাফিক্স রুম থেকে রস+আলো প্রিন্টের জন্য ছাড়তে ছাড়তে সিমু ভাই খালি বলেন, এই তো আর ১০ মিনিট।
তবে একটা জিনিস ছাড়া তাঁর আর সব কিছুই ভালো। আমাদের আড্ডা যখন দারুণ পর্যায়ে, তখনই তিনি এসে বলেন, ‘খালি আড্ডা দিলে হবে? আজকে বুধবার, কখন লিখবেন আর কখন কার্টুনিস্ট আঁকবে? কালকে বৃহস্পতিবার তো পাতার মেকআপ! দ্রুত শেষ করেন।’
কী আর করা! লেখা না শেষ হোক, আড্ডা তো শেষ করতেই হয়। তবে আপনাকেও এই আড্ডায় আমন্ত্রণ। যোগ দিতে চাইলে চলে আসুন শনিবার দিন সিএ ভবনের ছয় তলায় রস+আলো কারখানায়।
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০১০
Leave a Reply