আচ্ছা বলুন তো, ঢাকা বাংলাদেশের কী?
‘কী আর, রাজধানী!’
প্রশ্নকর্তা খুবই হতাশ হলেন। ‘আপনি তো দেখি এখনো পুরোনো যুগেই আছেন। ঢাকা যে বাংলাদেশের রাজধানী সে কি আর আমি জানি না?’
উত্তরদাতার এবার মনে হলো, আরে তাই তো! ঢাকা যে বাংলাদেশের রাজধানী এ তথ্যটি তো তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে তিনি ঠিক কী জানতে চেয়েছেন?
প্রশ্নকর্তা এবার একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘আচ্ছা বলুন তো, ঢাকা পৃথিবীর মধ্যে কেমন শহর?
উত্তরদাতা এবার একটু বুঝে-শুনে উত্তর দিলেন, ‘ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর।’
প্রশ্নকর্তা এবার আরও হতাশ হলেন উত্তর শুনে। ‘নাহ!’ তাঁর সব আশা যেন ফুরিয়ে গেল। ‘এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে এ ধরনের উত্তর আমরা আশা করি নাই। ভেবেছিলাম, ওরা বুঝি আরও অনেক বেশি চিন্তাশক্তিসম্পন্ন হবে।’
আচ্ছা শেষ প্রশ্ন, ‘বলুন তো বাংলাদেশের মানুষকে যদি প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করি তাহলে এ ভাগগুলো কী কী হবে?’
‘স্যার, নারী আর পুরুষ।’ উত্তরদাতার এই উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা যারপরনাই হতাশ হলেন।
ঢাকা শহরে যারা বাস করে, আসলেই তাদের আরও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার সেটি হলো, সহ্যশক্তি। ঢাকাকে এখন আর শুধু এ দেশের রাজধানীতে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে কি না সেটা বিবেচনার বিষয়। এর চেয়ে যদি বলি, ঢাকা এই দেশের পরীক্ষাক্ষেত্র! ইংরেজিতে বললে, এক্সপেরিমেন্টাল সিটি? প্রশ্নকর্তারা সম্ভবত এটাই শুনতে চেয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, খুব সম্ভবত ঢাকা পৃথিবীর রিকন্ডিশনড গাড়ির ভাগাড়। শেষ প্রশ্নটির উত্তর সবশেষে দিচ্ছি।
হাসান ছেলেটি সেদিন প্রথম গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে। সবার আগে সে যেটি দেখল তা হলো মানুষ রাস্তায় বসে বসে ঝিমোচ্ছে। এত গাড়ি ঢাকা শহরে কোত্থেকে এল, এটা কোনোভাবেই তার মাথায় ঢোকে না। রাস্তা বানানো হয়েছে গাড়ি চালানোর জন্য, সেই রাস্তায় যদি গাড়ির জন্য গাড়ি না চলে, বিষয়টা কেমন না? এটা তার মাথায় ঢুকতে অনেক দিন লেগে গেছে।
আমাদের বর্তমান সরকারের আগেই ঢাকার এই করুণ অবস্থা নিরসনে এগিয়ে এসেছিলেন তার আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কয়েকটি নতুন রাস্তা আর ট্রাফিক পুলিশের সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছিল। ফলাফল বলাটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
এরপর নির্বাচনের পর নতুন সরকার এল। রাস্তায় জ্যাম নিয়ে পত্রপত্রিকাগুলো লেখালেখি শুরু করল। সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগমন্ত্রী পত্রিকার রিপোর্টার নিয়ে কাঁচপুর সেতুতে জ্যাম দেখতে গেলেন। সাংবাদিকদের বললেন, এসব লেখার আগে তাঁর কাছ থেকে যেন জেনে রিপোর্ট লেখা হয়। পরদিন আবার পত্রিকায় কাঁচপুর সেতুতে কয়েক কিলোমিটার লম্বা জ্যামের ছবি ছাপা হলো। মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী আর কিছু বললেন না। মন্ত্রী মহোদয় ঢাকার ভেতরের জ্যাম রেখে কেন কাঁচপুর সেতুতে গেলেন জ্যাম দেখতে? কারণ, ঢাকা শহরে কোনো মন্ত্রীর গাড়ি যাওয়ার আগে পাবলিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে ক্ষমতাবানদের পথ করে দিতে হয়, এমন কি অ্যাম্বুলেন্সে বসা মৃত্যুপথযাত্রীও তা-ই করে। স্বাভাবিকভাবে সেই ক্ষমতাবানদের কাছে আমাদের অনেক আশা। সেই আশা পূরণ হয় কি না সে কথা বলা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
যা-ই হোক, বর্তমান সরকার শুরুতেই ঢাকার জ্যামের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে তাদের বিশাল পরিকল্পনা। রাস্তায় রাস্তায় প্রথমে ডিজিটাল সাইনবোর্ড বসানো হলো, যাতে গাড়ির চালকেরা পড়ে বুঝতে পারেন তাঁদেরও ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলা উচিত। কিন্তু যে দেশে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের ছড়াছড়ি, সেই দেশের চালকদের ডিজিটাল সাইনের কি কোনো মানে আছে? সরকার সেটা বুঝল। এভাবে পড়িয়ে-লিখিয়ে কাজ হবে না।
এরপর নতুন বুদ্ধি এল। সময় ভাগ করে দিতে হবে। দিনের একেক সময়ে একেক শ্রেণীর লোকেরা বের হবে। যেমন সকাল সাতটায় বুঝতে হবে এরা সবাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক। সকাল ১০টার সময় সবাই চাকরিজীবী। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হলো না। কারণ, মানুষের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নিশ্চয় সরকারি সময় মেনে চলে না। জ্যাম কমল তো না-ই, কারও কারও মতে নাকি বেড়েই গিয়েছিল।
আবার নতুন বুদ্ধি এল—রাস্তাকে বিভিন্ন লেনে ভাগ করে দিতে হবে। করা হলো লেন। কিন্তু যে বাসের ড্রাইভার নিজের নামটাও লিখতে পারেন না, কিংবা যাঁর ড্রাইভিং জ্ঞান বলতে শুধু ওভারটেক করে সবার সামনে থাকতে চাওয়া, তাঁর জন্য এসব কিতাবি লেন কাজ করল না।
সরকার পড়ল বিপাকে। বসাল পৃথিবীর উন্নত দেশের মতো সিসি ক্যামেরা। ক্যামেরাই স্বয়ংক্রিয় ছবি তুলে সিগন্যাল অমান্যকারী গাড়ির ছবি তুলে মামলা করে দেবে। কারও কারও মামলাও হলো। কিন্তু এক ক্যামেরা আর কয়টা গাড়ির ছবি তুলবে? সুতরাং এই চেষ্টাও খুব একটা কাজে এল বলে মনে হলো না। সর্বশেষ একটি পাঁচতারা হোটেলের পাশের রাস্তায় সরকার বাঁশ ফেলে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ট্রাফিক পুলিশেরা চেষ্টার ত্রুটি করছে না। কিন্তু তারা আর কী করবে? যেকোনো শহরে রাস্তা থাকা প্রয়োজন ২৫ ভাগ। আর ঢাকায় আছে মাত্র ৭ থেকে ৮ ভাগ। এই শহরের সব মানুষ যদি গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই যাতায়াত করতে চায় তবুও কি সম্ভব জ্যাম ঠেকানো?
এবার একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বাসায় টেলিফোন নষ্ট। বাসার কর্ত্রী তো পড়েছেন মহাবিপদে। টেলিফোন ডেড হলে তিনি কথা বলবেন কীভাবে? টিঅ্যান্ডটিতে ফোন করা হলো। ওরা জানাল, লাইন ঠিক আছে। তাহলে নিশ্চয় সেটের সমস্যা। নতুন সেট কেনা হলো। কাজ হলো না। দিন-রাত এই টেলিফোন নিয়ে পড়ে থাকলেন সবাই। কিন্তু কিছুতেই কথা বলা গেল না। শেষতক সবাই যখন ক্ষান্ত দিলেন তখন দেখলেন বাসার ছোট ছেলেটি মূল লাইন থেকে দেয়ালের পাশ থেকে আসা টেলিফোনের তারের কিছু অংশ কেটে খেলছে। কে জানে আমাদের ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা টেলিফোন তারের মতো কি না।
কিন্তু এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শোনা যাচ্ছে, সরকার নাকি চিন্তা করছে পাতালট্রেন দেবে ঢাকার নিচ দিয়ে। আমাদের একটাই প্রশ্ন—জনাব, কীভাবে? ওই ট্রেন লাইন করার আগে কি ঢাকাবাসীকে কয়েক বছর অন্য শহরে গিয়ে থাকতে হবে?
ঢাকাবাসী যেন সরকারের পরীক্ষাগারের গিনিপিগ। যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, সব তাদের ওপর দিয়ে। সবশেষে সেই তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তর। বাংলাদেশে সব সময় দুই ধরনের লোক বাস করে। কিংবা যাঁরা আছেন, তাঁদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আশাবাদী আর নিরাশাবাদী। যাঁরা কোনো কারণে সরকারি দলের সমর্থক, তাঁরা সব সময় আশাবাদী হন। আর বিরোধী দলের লোকেরা থাকেন নিরাশাবাদী। আবার প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এটার পরিবর্তন হয়। তাই ঢাকায় বসবাসের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো গায়ে মোটা চামড়া থাকতে হবে। চামড়া একটু পাতলা হলে প্লিজ ঢাকা ছেড়ে চলে যান। দেখেন না বছরের পর বছর ধরে এ দেশের ক্ষমতাবানেরা কীভাবে ঢাকায় কৃতিত্বের সঙ্গে বসবাস করে যাচ্ছেন, তাঁদের অনুসরণ করুন। যে যত যা-ই বলুক, আর যতই খারাপ লাগুক, সব সময় সরকারি আর বিরোধী দলের মতো সহ্যক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার চেষ্টা করুন। ঢাকা আপনাকে বিমুখ করবে না।
তাওহিদ মিলটন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০১০
Leave a Reply