প্রিয় দেবা,
তোমাকে সাধু ভাষায় চিঠিখানি লিখিতেছি। এতে অসাধু কোনো উদ্দেশ্য আমার নাই। শুনিলাম, তুমি বিবাহ করিতে যাইতেছ। তুমি বিবাহ করিতেছ এতে আমি যতটা না বিস্মিত, তার চাইতেও বেশি বিস্মিত—তোমাকে কেহ বিবাহ করিতেছে!
এবং আমি খানিকটা শঙ্কিতও। বিবাহিত মানেই যে ‘অতিবাহিত’—এ তো তোমাকে অনেকবারই বুঝাইয়াছি। আমার কথায় না হয় তুমি গুরুত্ব দাও না। কিন্তু তোমারই প্রিয় গায়ক নচিকেতাও তো গানে গানে বলিয়া গেছেন, ‘পুরুষ মানুষ দুই প্রকার—জীবিত, বিবাহিত।’
দর্শনের ছাত্র ছিলে তুমি। সক্রেটিস তোমার প্রিয় দার্শনিক। নিশ্চয়ই জানো, জান্থিপের মতো বউ ছিলেন বলিয়াই এত বড় দার্শনিক হইয়াছিলেন সক্রেটিস। শোনা যায়, এথেন্সের রাস্তায় জান্থিপে নাকি প্রকাশ্যে ঝাড়ু হাতে তাড়া করিতেন তাঁহার ভাবুক স্বামীকে। বড় আক্ষেপ নিয়া সক্রেটিস তাই বলিয়া গিয়াছেন, ‘অবশ্যই বিবাহ করিবে। যদি একজন ভালো স্ত্রী পাও, জীবনে সুখী হইবে। আর যদি খারাপ স্ত্রী পাও, তুমি হইবে দার্শনিক!’
কিংবা রুশোর কথাই ধরো। তাঁর সেই সর্বাধিক জনপ্রিয় উক্তি—‘মেন আর বর্ন ফ্রি, বাট আর এভরিহয়ার ইন চেইনস’। কে জানে, রুশোর এই উপলব্ধি বিয়ের পরেই হইয়াছিল কিনা! কারণ রুশোর কথা থেকে ধার করিয়া একজন এমন মন্তব্য করিয়াছেন, ‘হ্যাঁ, জন্মগতভাবে মানুষ স্বাধীনই থাকে, কিন্তু এরপর সে বিবাহ করে ফেলে।’
বিবাহের মাধ্যমে পুরুষ তার ‘ব্যাচেলর’ ডিগ্রি হারাইয়া ফেলে, আর স্ত্রী অর্জন করে ‘মাস্টার্স’! কোন বিষয়ে মাস্টার্স তাহা তোমার নববধূ অচিরেই বুঝাইয়া দেবে। ইহা তাই বিশদ লিখিলাম না। তবে এ টুকু বলিয়া রাখি, বিবাহ মানেই পরাধীনতা। বিবাহ মানে টিভির রিমোটের ওপর তোমার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ক্ষুণ্ন হওয়া। আর তাই গুণীজনেরাই বলেন, বিবাহের সময় কনের অনামিকায় ওঠে আংটি আর বরের হাতে পড়ে হাতকড়া! জানি, ‘আর কত রাত একা থাকব’ গানটি শোনার পর হইতেই তোমার মতিভ্রম হইয়াছে। বুকের কোণে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি আনিয়া দিয়াছে শূন্যতার হাহাকার। কিন্তু তোমার প্রিয় লেখক আন্তন চেখভ কী বলিয়া গেছেন মনে নাই? বলিয়াছেন, ‘যদি একাকিত্বে ভয় লাগে তোমার, কখনো বিয়ে করো না।’ বন্ধু অ্যালেক্সেই সুভোরিনকে লেখা এক চিঠিতে চেখভ লিখিয়াছিলেন, ‘আমি অবশ্যই বিবাহ করিব, তুমি যদি চাও। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে… আমাকে এমন একটা বউ এনে দাও, যে হবে চাঁদের মতো, যে আমার আকাশে রোজ রোজ দেখা দেবে না।’
বিবাহের আগে বিবাহ-সংক্রান্ত একটা নাটক লিখিয়াছিলেন চেখভ—আ ম্যারেজ প্রপোজাল। হাস্যরসাত্মক প্রহসন ছিল সেটি। কেন জানি মনে হয়, বিবাহের পর সেই নাটকটি লিখিলে প্রহসনের বদলে আ ম্যারেজ প্রপোজাল হইয়া উঠিত সার্থক এক ‘ট্র্যাজেডি’!
জানি, তুমি কী ভাবিতেছ। জানি, তোমার যুক্তি। রাশিয়ার এক সময়ের এই ‘এলিজিবল ব্যাচেলর’ নিজেও এক সময় বিবাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু এও জানিবে, বিবাহের এক মাস আগেই হবু স্ত্রী ওলগা নিপারকে পাঠানো এক পত্রে চেখভ লিখিয়াছিলেন, ‘বিয়ে নিয়ে আমার একটা আতঙ্ক আছে। অভিনন্দনের পর অভিনন্দন, শ্যাম্পেন, গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং তোমার অশেষ দেঁতো হাসি।’
বিবাহের দিন ওলগা এমন বিজয়ীনির হাসি হাসিয়াছিলেন কি না, তাহা আমরা জানি না। তবে সচরাচর শুভদিনে প্রায় পুরোটা সময় কনেরা কাঁদে। তোমার হবু স্ত্রীও কাঁদিবে। তাহাতে বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। কারণ জানিবে, পরদিন হইতে তাঁহার ক্রন্দনের দিন শেষ, আর তোমার শুরু! বিবাহের পর ভালোবাসা তো তোমাকে খুঁজিতেই হইবে, না হইলে থাকিবে কোথায়? তবে ভালোবাসা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করিও না। কারণ বিবাহ হইল অনেকটা টেনিস খেলার মতো। যেখানে ‘লাভ’ মানে শূন্য! আরেক অখ্যাত দার্শনিক বলিয়াছেন, ভালোবাসা হইল ঘুমের মধ্যে দেখা সুন্দর একটা স্বপ্ন, আর বিবাহ হইল একটা অ্যালার্ম ঘড়ি।
জানি, এইসব বলিয়া আর লাভ নাই। কারণ বিবাহ হইতেছে ইঁদুর কলের মতো। যাঁরা মুক্ত থাকে, তাঁহারা সেই ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চায়। আর যাঁহারা সেই ফাঁদে আটকা পড়ে, তাঁরা চায় ফাঁদ হইতে মুক্তি। তোমাকে শুধু সুখী, দাম্পত্য জীবনের একটাই সূত্র বলিয়া দিতে চাই। কখনো বউয়ের অবাধ্য হইবে না। গৃহপালিত একান্ত বাধ্যানুগত স্বামীদের কদরই এই জগতে সবচাইতে বেশি। সফল স্বামী হইল সেই, যে মুখ বন্ধ রাখে, আর খোলা রাখে চেক বই। অন্যের কথা ধার করিয়াই পত্রখানি ভরিলাম। শেষাংশে আসিয়া এস টি কোলরিজের সেই উক্তি তোমাকে স্মরণ করিয়া দেওয়ার লোভ সামলাইতে পারিতেছি না। ব্রিটিশ কবি বলিয়াছেন, ‘আমার মতে, সবচেয়ে সুখী দম্পতি হবে সেই জুটি, যেখানে স্বামী হবে বধির, আর স্ত্রী হবে অন্ধ!’
লুকাইয়া লুকাইয়া লেখা পত্রখানি শেষ করিতেই হইতেছে। কারণ আমার স্ত্রী যদি দেখে রাত্রি জাগিয়া আমি এই সব ‘অর্থহীন লেখালেখি’ করিতেছি, তাহা হইলে আর নিস্তার নাই। গুরুচণ্ডাল এবং আরও বহু দোষে দুষ্ট এই পত্রে তোমাকে মনোবেদনা দিয়া থাকিলে…ক্ষমা চাহিয়া আর কী লাভ? অন্তঃসারশূন্য জীবনে সং সাজিয়া সংসার করিতে চলিতেছ, এর চাইতে বহুগুণ কষ্ট যে তোমাকে সইতে হইবে বাবা!
রাজীব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০১০
Leave a Reply