সাহিত্যের শিক্ষক সের্গেই কাপিতোনিক আখিনোভের মেয়ের বিয়ে। বর ইতিহাস ও ভূগোলের শিক্ষক। নাচ-গান আর গল্পে গল্পে ভালোই জমেছিল বিয়ের আসর। সোফায় পাশাপাশি বসে একজন গণিত শিক্ষক, একজন ফরাসি শিক্ষক ও একজন ট্যাক্স অফিসার পরস্পরের বক্তব্যে বাধা দিতে দিতে গল্প করছিলেন। গল্পের বিষয়বস্তু ভয়ংকর হলেও মনোহর।
মাঝরাতে বাড়ির কর্তা রান্নাঘরে গেলেন রাতের খাবারটা হয়েছে কি না দেখতে। রান্নাঘরের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বুনোহাঁস, পাতিহাঁস আর অন্যান্য খাবারের ম-ম গন্ধে সয়লাব। লালমুখো রাঁধুনি মার্ফা তার পিপের মতো শরীরটা নিয়ে দাপিয়ে দাপিয়ে কাজ করছিল।
‘স্টার্জানটা দাও তো মার্ফা, একটু চেখে দেখি,’ ঠোঁট চাটতে চাটতে বললেন আখিনোভ।
জেলি, কেইপার, জলপাই আর গাজর দিয়ে সাজানো বিশাল স্টার্জান মাছটা দেখেই চকচক করে উঠল আখিনোভের চোখ দুটো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, আঙুল কামড়ে, ঠোঁট দিয়ে শব্দ করে উঠলেন, ‘চুকচুক!’
‘আহা! এ যে একেবারে আবেগময় চুমুর শব্দ। মার্ফা, তুমি কাকে চুমু খাচ্ছ গো? ও! সের্গেই কাপিতোনিক!’ দরজায় ভাস্কিনের মুণ্ডু দেখা গেল।
আখিনোভ যেন বেকুব বনে গেলেন।
‘হাঁদারাম কোথাকার! আমি কোথায় চুমু খাচ্ছিলাম? আমি তো শুধু ঠোঁট দিয়ে চুকচুক শব্দ করেছি মাছটা দেখার আনন্দে।’
‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে গেল ভাস্কিন।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন আখিনোভ। পিয়ানোর পাশে দাঁড়ানো ভাস্কিন ইন্সপেক্টরের মেয়ের কানে কানে কী যেন বলতেই মেয়েটি হেসে উঠল।
‘বদমাশটা বলল আর মেয়েটা বিশ্বাস করল? হায়, ঈশ্বর! নাহ্! এ আমি হতে দেব না। আমি সবাইকে বলে দেব। সবাই জানুক, ভাস্কিন একটা বদমাশ, চগলখোর।’ ভাবতে ভাবতে ফরাসি ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন আখিনোভ। বললেন, ‘হয়েছে কি, আমি ডিনারটা দেখতে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে। জানেনই তো, মাছ আমার খুব প্রিয়। দেড় গজ লম্বা একটা স্টার্জান রাঁধিয়েছি আজ। হা হা, যাহ্, আমি তো ভুলেই যাচ্ছিলাম, মাছটা দেখে আমি খুশিতে চুকচুক করে উঠলাম। আর তখনই ওই বদমাশ ভাস্কিন বলে কি না, “চুমু খাওয়া হচ্ছে?” হা হা! ভাবুন তো—কোথাকার কোন চাকরানি, পিপের মতো দেখতে! তাকে চুমু খাব আমি? আজব!’
‘কে আজব?’ এগিয়ে এলেন গণিতের শিক্ষক।
‘আর কে? ওই ভাস্কিন। হয়েছে কি, আমি রান্নাঘরে গেলাম…হুহ্! মার্ফাকে কেন চুমু খেতে যাব আমি? আমি চুমু খেতে চাইলে মেয়ের অভাব আছে নাকি?’
এবার যোগ দিলেন ট্যাক্স অফিসার। ‘আরে ওই হতভাগা ভাস্কিন!’ বলেই চলেছেন আখিনোভ, ‘ও রান্নাঘরে গিয়ে আমাকে মার্ফার পাশে দেখে ফালতু সব গল্প ফাঁদতে শুরু করল। বলে কিনা, “আপনারা চুমু খাচ্ছেন কেন?” আরে মার্ফার চেয়ে তো একটা টার্কিকে চুমু খাওয়াও ভালো। হেহ্! হাসিয়ে মারল।’
‘কে হাসিয়ে মারল?’ এবার আলোচনায় যোগ দিলেন এক পাদ্রি।
‘কে আবার? ভাস্কিন। আমি রান্নাঘরে…ওহ্! অনেক হয়েছে। দাঁড়ান। ডাক দিই হতচ্ছাড়াকে। ও-ই সব খুলে বলুক।’
আখিনোভ এভাবে সবাইকে ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। তাঁর মনে একটাই ভয়, বদমাশ ভাস্কিন যদি সবার কাছে এই মিথ্যা অপবাদটা ছড়িয়ে দেয়? তাই নিজেই আগ বাড়িয়ে সব জায়গায় আসল ঘটনাটা ব্যাখ্যা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন।
অবশেষে অপবাদ থেকে মুক্তির আনন্দে রাতে পাক্কা চার পেগ পান করলেন আখিনোভ।
নিষ্পাপ শিশুর মতো পরদিন ঘুম থেকে উঠে সবকিছু ভুলে গেলেন তিনি। কিন্তু, হায়! মানুষ ভাবে এক, ঈশ্বর করেন আরেক। পরের সপ্তাহে টিচারস রুমে আখিনোভকে এক কোনায় ডেকে নিয়ে প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘মাফ করবেন, সের্গেই কাপিতোনিক। আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার কথা বলার অধিকার নেই। কিন্তু না বলেও পারছি না। শুনলাম, আপনার নাকি বাড়ির রাঁধুনির সঙ্গে প্রেম চলছে? মানে, বলছিলাম কি, দেখুন, আপনি তাকে চুমু খাবেন খান, কিন্তু এ নিয়ে এত ঢাকঢোল পেটাবেন না। মনে রাখবেন, আপনি একজন স্কুল শিক্ষক।’
বাড়ি ফেরার পর আখিনোভকে দেখতে ঠিক একঝাঁক মৌমাছির কামড় খাওয়া মানুষের মতো লাগল।
‘রোজ তো গপগপ করে গেল, আজ কী হলো?’ ডিনার টেবিলে খেঁকিয়ে উঠলেন আখিনোভের স্ত্রী, ‘বলি, কিসের এত চিন্তা? ও। মার্ফাকে মনে পড়ছে বুঝি? জানি জানি। তোমার বন্ধুরা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। জংলি ভূত কোথাকার!’ বলেই আখিনোভের গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলেন।
খাওয়া ফেলে আখিনোভ ছুটলেন ভাস্কিনের বাড়ি। ভাস্কিন বাড়িতেই ছিল।
‘ব্যাটা বদমাশ! কেন আমার নামে এত বড় অপবাদ দিলি?’ চেঁচিয়ে উঠলেন আখিনোভ।
‘কিসের অপবাদ?’
‘তুই গুজব ছড়াসনি যে আমি মার্ফাকে চুমু খেয়েছি?’
‘কী বললেন? হে ঈশ্বর! আমার চোখ কানা করে দাও। আমি যদি আপনার ব্যাপারে একটি কথাও
বলে থাকি, তাহলে
আমার বাড়িঘর সব যেন ভেঙে পড়ে, আমার যেন কলেরার চেয়ে কঠিন ব্যামো হয়।’
অপবাদের রচয়িতা যে ভাস্কিন নয়, এ ব্যাপারে আখিনোভ আর কোনো সন্দেহই রইল না।
‘তাহলে কে? কে?’ বুক চাপড়ে সারা দিন নিজেকে এ প্রশ্নই করতে থাকলেন আখিনোভ।
আন্তন চেখভ: রুশ ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও চিকিত্সক। জন্ম-১৮৬০, মৃত্যু-১৯০৪।
ভাষান্তর: আলিয়া রিফাত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply