আগেকার দিনে কাঁটা নিয়ে যেমন কবিতা লেখা হয়েছে, এখন থেকে সেই তালিকায় আরও দু-চারটা কবিতা যোগ হয়ে যায় কি না খেয়াল না রেখে উপায় নেই। তাহলে আজীবন খোঁচা মারা অব্যাহত থাকবে।
প্রিয় ক্রিকেট দল,
জীবনানন্দ দাশ সেই কত বছর আগেই শুনতে পেয়েছিলেন শিশিরের শব্দ! উনি জানতেন, শিশির সন্ধ্যাবেলা ঝামেলা করে। তাই তো তিনি ‘বনলতা সেন’ কবিতায় লিখে গেছেন, ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/সন্ধ্যা আসে;…’ কিংবা রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের ‘সেই দিন এই মাঠ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে…’। কবি দিনের পর দিন পর্যবেক্ষণ করে এই চিরসত্য জানতে পেরে তা আমাদের জানিয়েছিলেন কবিতার ছন্দে। প্রিয় ক্রিকেট দল, আপনারা কেন কবির বর্ণিত এই সত্যবাণীর প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি? কেন আপনারা টসে জিতেও ব্যাটিংমুখী হলেন? আপনারা কি জীবনানন্দের কাব্য পড়েননি? দিনের সূর্য চলে গেলে ‘মাঠের ঘাস তো ভিজিবেই শিশিরের জলে’। তা ছাড়া, ‘ডিউ ফ্যাক্টর’ করতে করতে দেশি-বিদেশি ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক আর বিশেষজ্ঞরা মুখে একেবারে শিশির জমিয়ে ফেললেন, অথচ আপনারা তাঁদের কথা শুনলেন না। সূর্যের ঝলমলে আলোয় ঝলসে গেল আপনাদের চোখ। আর শিশিরের কারণে বল বোলারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে না—এটাও তো ধ্রুব সত্যই। আগের সব কটি ম্যাচেও পরে ব্যাটিং করে জিতেছে সবাই। তাহলে কেন, কেন ব্যাটিং নিলেন আগে?
‘বৃষ্টি পড়ছে—বৃষ্টি ইজ রিডিং’ পাঠ্যবইয়ে বৃষ্টি নামের মেয়ের পড়তে বসা নিয়ে এ ধরনের ট্রান্সলেশন থাকলেও শিশির পড়ার কথা কোথাও শোনা যায়নি। শিশির কখনো পড়ে না। শিশির সব সময় জমে। বর্তমানকালের কবিরাও লিখেছেন, ‘সবুজ-শ্যামল ঘাসের আগায় শিশির জমেছে ওই,/মাগো আমার কালো রং-এর ছাগল গেল কই!’ তবে ‘কুয়াশা’র সঙ্গে ‘পড়া’র একটা সম্পর্ক রয়েছে। একসময় দেশের রহস্যপ্রেমী পাঠকেরা নিয়মিত কুয়াশা (সেবা প্রকাশনীর গোয়েন্দা সিরিজ) পড়ত। কুয়াশা হলো মাটিতে নেমে আসা মেঘ। বাতাস যদি জলীয় বাষ্পে অতি সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তাহলে কুয়াশার সৃষ্টি হয়। কুয়াশার সঙ্গে তাপমাত্রার চেয়ে আর্দ্রতার সম্পর্ক বেশি। কিন্তু শিশির জমা নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠ এবং বাতাসের তাপমাত্রার পার্থক্যের ওপর। যখন ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাতাসের আগে কমে, এরপর যখন বাতাস ঠান্ডা হওয়া শুরু করে, তখন বাতাসে থাকা অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন শীতল বস্তুর (যেমন ঘাস, গাছের পাতা, টিনের চাল, মাকড়সার জাল) ওপর বিন্দু বিন্দু (মডেল ও অভিনেত্রী বিন্দু বলে ভুল করবেন না) পানি জমে। একটা গ্লাসে ঠান্ডা পানি ঢাললে গ্লাসের বাইরের তলে বিন্দু আকারে পানি জমে—সহজভাবে বললে এটাই শিশির।
মর্নিং শোজ দ্য ডে—ইংরেজিতে এ রকম প্রবাদ থাকলেও মর্নিং শোজ দ্য ডিউ (শিশির)—এই ধরনের কোনো প্রবাদ নেই। অর্থাত্, সকালের রোদ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে সন্ধ্যায় শিশির থাকবে কি থাকবে না। সকালের রোদ দেখে আপনারা কী করে ভাবলেন যে সন্ধ্যায় শিশির থাকবে না? তা ছাড়া শিশির ও রোদের মধ্যে কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হয়নি যে দিনে রোদ উঠলে রাতে আর শিশির ঝরবে না। এই চিরন্তন সত্যের প্রতি আপনাদের আস্থা রাখা উচিত ছিল।
বাংলাদেশ স্পিননির্ভর দল, অথচ আপনারা ভাবলেন না স্পিনারদের কথা। রাতে বোলিং করলে শিশিরে ভেজা বল তাঁরা কীভাবে টার্ন করাবেন, সেটা নিয়ে আরও ভাবনার অবকাশ ছিল। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের আগে ব্যাট করতে দিলে তাঁরা চার-পাঁচ শ রান করে ফেলবেন—এই ভয়ে আগে থেকে কাবু হয়ে গেলেন? রান তো করারই জিনিস, করতেন তারা! পরে আপনারাও করতেন! আপনাদের রান করতে তো কেউ মানা করত না। এমন তো নয় যে, আমরা রান করতে পারি না। আমাদেরও তো ব্যাট আছে, ব্যাটসম্যানও আছে। অথচ সবকিছু বাদ দিয়ে আপনারা শুনলেন প্রখ্যাত ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেসের কথা। সেই আমলে তিনি দিয়েছিলেন এই ব্যাটিং তত্ত্ব, ‘টসে জিতলে প্রথমে ব্যাটিং করো, সন্দেহ থাকলে একটু ভেবে তারপর ব্যাটিং করো। তার পরও সন্দেহ থাকলে সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাটিং করারই সিদ্ধান্ত নাও।’ কিন্তু ঢাকার মিরপুরে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে যখন সিরিজের প্রথম ম্যাচ থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ‘শিশিরতত্ত্ব’, তখন আপনারা মানলেন ‘গ্রেসতত্ত্ব’। ঠেলায় পড়ে বাঘ আর মহিষ এক ঘাটে জল খেলেও এক মাঠে যে ক্রিকেটের দুটি বিপরীতমুখী তত্ত্ব খাটে না, সে তো প্রমাণিত হয়েই গেল।
অতএব, বামপক্ষ = ডানপক্ষ (প্রমাণিত)
সিমু নাসের
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply