প্যারিসে গেলে লুভর মিউজিয়ামে যাওয়া নিয়ম। বিশেষ করে মোনালিসা দেখে না আসা অপরাধের মধ্যে পড়ে। তাতে মোনালিসাকেও অপমান করা হয়। তাই প্যারিসে গেলেই মোনালিসাকে দেখে আসতে হয়। মোনালিসার বাস লুভর মিউজিয়ামে।
ইউরোপে সহজে ফ্রি কিছু পাওয়া যায় না। সবকিছুই দাম দিয়ে কিনতে হয়। খানিকটা ব্যতিক্রম লুভর। তবে এ জন্য একটি ‘যদি’ আছে। আর তা হলো মাসের প্রথম রোববার লুভরে যেতে হবে। এদিন লুভরে প্রবেশ বিলকুল ফ্রি। ফ্রি বলেই নানা সমস্যা। পুরো প্যারিসবাসী মনে হয় এই দিনের অপেক্ষায় থাকে। লম্বা লাইন, প্রবেশ কষ্টকর।
নানাজনের নানা পরামর্শ মেনে লুভরের সামনে হাজির হলাম সকাল আটটায়। প্যারিসে সূর্যের আলো দেখা যায় নয়টার দিকে, আটটা মানে তখনো অন্ধকার। দেখলাম আমার চেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ আছে, লাইনে আমার সামনে আরও চারজন। কনকনে শীত। ‘মোনালিসা’ দেখার আনন্দে মাফলার আনতে ভুলে গেছি, সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছি ছাতা না এনে। চরম বিরক্তিকর হিসেবে ইউরোপের বৃষ্টি পৃথিবী বিখ্যাত। তীব্র ঠান্ডার মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল থেমে থেমে।
আমার সামনে ভিনদেশি এক জুটি, ঠিক পেছনেও তাই। কথা শুনে ভাষা চেনা গেল না। পেছনের মহিলা সুন্দরী অথচ হূদয়হীনা নন। বৃষ্টি হতেই নিজের ছাতাটা আমাকে দিয়ে দিলেন। মমতাময়ীর মমতায় বৃষ্টির সমস্যা মিটলেও শীত থেকে সহজে বাঁচা গেল না। সামনের জুটি ইউরোপিয়ান কায়দায় শীত থেকে মুক্তির চেষ্টা করে যেতে লাগল পুরোটা সময়।
আটটার সময় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু কখন ঢুকতে দেবে কেউ জানি না। লুভরের প্রবেশপথটা পিরামিড আকারের মতো তৈরি করা। পেছন ফিরে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। সামনের খোলা চত্বরটা দীর্ঘ। লাইন লুভর ছাড়িয়ে বাইরে চলে গেছে। মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম হবে না। সবই ঠিক আছে, কিন্তু দরজা আর খোলে না। এদিকে অনেক ভোরে এসেছি বলে সকালে খাওয়া হয়নি। অভিজ্ঞদের দেখলাম খাবার সঙ্গে নিয়েই এসেছে, কেবল আমিই অভুক্ত।
প্রতিবছর ৬০ লাখের বেশি মানুষ লুভরে যায় মোনালিসাকে দেখতে। এই ৬০ লাখের বড় অংশই যে মাসের প্রথম রোববার যায় তা বুঝতে সময় লাগল না। ১০টার মধ্যে পুরো চত্বরটা ভরে গেল। ১০টার দিকে দেখি দুইটা বোর্ড রাখা হলো আমাদের সামনে। এই প্রথম সেখানে ইংরেজি কিছু লেখা পেলাম। ফরাসি ভাষায় তো আছেই লেখা, নিচে আবার ইংরেজি করে দেওয়া। সেখানে বলা আছে, যাঁদের কাছে ব্যাগ আছে তাঁরা ঢুকবেন ডানের দরজা দিয়ে, আর ব্যাগছাড়া যাঁরা তাঁরা বাঁয়ের দরজা দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে আমি বাঁয়ের দরজার এক নম্বর ব্যক্তি হয়ে গেলাম। ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকল, ওই দিন লুভরে প্রথম প্রবেশ করেছিল একজন বাংলাদেশি। ঠিক সোয়া ১০টায় এই ইতিহাস রচিত হয়েছিল।
একদিনে লুভর দেখা সম্ভব না। সাত দিনে দেখা সম্ভব এ কথাও বলা যায় না। আমার হাতে সময় মাত্র এক দিন। সে কারণেই সবার আগে লুভরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল মাথায়, লুভরে ঢুকলামও সবার আগে। পুরো লুভর হেঁটে হেঁটে দেখতে হলে প্রচুর প্রাণশক্তির প্রয়োজন। তাই ভাবলাম, আগে কিছু খেয়ে নিই। খাওয়ার ব্যবস্থা আছে সেখানে। উদরপূর্তি করে ভাবলাম, এবার তাহলে লুভর দেখা হোক। যেখানে বসে খেলাম তার ঠিক পাশে ছোট একটা সিঁড়ি। কোথা থেকে লুভর দেখা শুরু করব, মোনালিসা আগে দেখব না পরে—এসব ভাবতে ভাবতে সেই ছোট সিঁড়িটা দিয়ে ওপরে উঠলাম কিছুটা। তারপর দেখলাম আরেকটা সিঁড়ি। সেটা দিয়ে খানিকটা ওপরে উঠতেই একটু বেশি শীত করতে লাগল। ভেতরে তো এতটা শীত লাগার কথা না। ভাবলাম এখানে মনে হয় বিশেষ কোনো চিত্রকর্ম রয়েছে। সেই আগ্রহে আরেকটু এগিয়ে যেতেই খোলা এক চত্বরে চলে এলাম। আর নিজেকে আবিষ্কার করলাম লুভরের বাইরে। নিজের অজান্তে আমি আসলে লুভরের জরুরি নির্গমনের সিঁড়ি দিয়ে বাইরে চলে এসেছি। এর মাধ্যমে রচিত হলো আরেকটি ইতিহাস। লুভরে সবচেয়ে কম সময় থাকা দর্শনার্থীদের মধ্যে আমার অবস্থান সম্ভবত শীর্ষে।
তারপর? আবার লাইনের শেষ খুঁজে পেলাম লুভরের একদম বাইরের রাস্তায়। আমি যখন দাঁড়ালাম, আমার সামনে তখন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। কে জানে দ্বিতীয়বার লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যেও হয়তো আমিই ছিলাম প্রথম।
শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply